শ্রমজীবী মানুষের জীবন যন্ত্রণা
নুন কবিতা |
1988 সাল স্বাধীনতার পর কেটে গেছে প্রায় চল্লিশটা বছর। তবু এ গণতান্ত্রিক দেশে শ্রমজীবী মানুষ পায়নি জীবন ধরনের অধিকার। অল্পে তুষ্ট এই মানুষগুলোর জীবন কাটে সাধারণ “ভাত-কাপড়ে”।তার উপর আছে অসুখ-বিসুখ,ধার দেনার মতো বিপদ আপদ। অন্তহীন দৈন্য দিয়ে গড়া তাদের জীবন। কখনো কখনো সাধারণ ভাত-কাপড়টুকুও তাদের জোটে না। কবির ভাষায়-
“সব দিন হয় না বাজার”।
ফলে অনাহারে, অর্ধাহারে কাটে দিন।
আর পাঁচটা সুখী মানুষের মতো তাদের জীবনে নেই কোনো পরিকল্পনা। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তাদের জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। তাই কোনোদিন মাত্রাছাড়া বাজার হয় আবার কোনোদিন বা বাজারই হয় না। তবে তারাও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। তাই মাঝে মাঝে তাদের মনে উঁকি দেয় আশা আকাঙ্খার অঙ্কুর লাগে, লাগে রোমান্টিকতার আবেশ। সেই আবেশে তারা কখনো বা গোলাপ চারা কিনে আনে। কিন্তু অবহেলিত ,বঞ্চিত এই মানুষগুলোর অন্তরে প্রতিমুহূর্তে অসংখ্য আকাঙ্ক্ষার জন্মায় আর মরে। তাই গোলাপ চারা রোপণ করলেও স্বপ্ন পূরণের পথে উঁকি দেয় সংশয়।
“ফুল কি হবেই তাতে”?
এ সংশয়, এই অনিশ্চয়তা এই অপ্রাপ্তি যখন তাদেরকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে তখন দুঃখ ভোলার একমাত্র উপায় হিসাবে তারা বেছে নেয় গঞ্জিকা সেবন। কবি অকপট ভাষায় বলেছেন –
“টান দিই গঞ্জিকাতে”।
মুখোশ যেমন মুখকে আড়াল করে কিন্তু মুছে ফেলতে পারে না তেমনি করে গঞ্জিকার নেশা তাদের সাময়িক দুঃখ ভোলালেও তা দূর করতে পারে না। তাই সারাদিনের পর মাঝরাতে কর্ম ক্লান্ত শরীর নিয়ে অন্ন গ্রহনের সময় ঠান্ডা ভাতে নুন টুকু না পেয়ে অন্তরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ছড়িয়ে যায় সব সীমারেখায়। তখন খেতে বসে রাগ চড়ে যায়-
“নুন নেই ঠান্ডা ভাতে”।
উত্তরোত্তর রাগ বৃদ্ধির ফলে বাপ বেটার চিৎকার চেঁচামেচিতে মধ্যরাতে স্তব্ধ নিদ্রাচ্ছন্ন পাড়া মাথায় ওঠে। তাদের সামাজিক জীবনে পিতা-পুত্রের সম্ভ্রম সূচক সম্পর্কের বাধন ছিঁড়ে যায় আর পারিবারিক সম্মানটুকুও বিকিয়ে যায় পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে। একরাশ অসম্মান হয় তাদের পাথেয়।
নিত্যদিনে এই অসম্মান আর তিলে তিলে ক্ষয় একসময় তাদেরকে বেপরোয়া করে তোলে। তখন এ বক্তব্যে বাধা থাকে না-
“করি ত কার তাতে কি”?
সঙ্গে সঙ্গে এক রাশ অভিমান দলা পাকিয়ে ওঠে বুকের কাছে-
” আমরা তো সামান্য লোক”।
তখন স্বাভাবিকভাবেই অবহেলিত শ্রমজীবী মানুষের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে বেঁচে থাকা ন্যূনতম
চাহিদা পরিতৃপ্তির-
” আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক”
এভাবে সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা দুর্বল উৎপীড়িত মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের
হিসাব কখনো নিলে না- বাস্তব যুগ যন্ত্রণার রূপকার জয় গোস্বামীর “নুন” কবিতায় তাদেরই জীবনযাত্রার কথা ফুটে উঠেছে। তারাই এসেছে সভ্য মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।