রাষ্ট্র | একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় অধ্যায় | সব উত্তরের PDF একত্রে | The State | ClassGhar |

  


1.
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, অসম ও ত্রিপুরা কি রাষ্ট্র?

    ‘রাষ্ট্রশব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল স্টেট (State)। আবার ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গ,
বিহার, ওড়িশা, অসম, ত্রিপুরা প্রভৃতি ২৮টি অঙ্গরাজ্যকেও ইংরেজিতে বলা হয় ‘স্টেট’।
যেমন
স্টেট অফ ওয়েস্টবেঙ্গল। ফলে সংশয় দেখা দেয় যে, এই, স্টেট শব্দটি কী অর্থে
ব্যবহৃতরাষ্ট্র অর্থে না রাজ্য বা প্রদেশ অর্থে। তাই বিচারবিশ্লেষণ করে দেখা দরকার
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, অসম বা ত্রিপুরাকে কেন রাষ্ট্র বলা যাবে না। রাষ্ট্রের
অপরিহার্য চারটি বৈশিষ্ট্য হল-[i] জনসমষ্টি, [2] নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, [3] সরকার এবং
[4] সার্বভৌমত্ব।

(1)
জনসমষ্টি :
রাষ্ট্র গঠনের প্রথম এবং অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হল জনসমষ্টি। জনগণ ছাড়া
রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গসহ প্রতিটি ভারতীয় অঙ্গরাজ্যেরই এই বৈশিষ্ট্য
রয়েছে।

(2)
নির্দিষ্ট ভূখণ্ড :
আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্র বা বৃহৎ যাই হােক না কেন, প্রতিটি ভারতীয়
অঙ্গরাজ্যের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড আছে। অতএব, রাষ্ট্র গঠনের দ্বিতীয় মৌলিক উপাদানটিও
পশ্চিমবঙ্গসহ প্রত্যেকটি ভারতীয় অঙ্গরাজ্যে উপস্থিত।

(3)
সরকার :
প্রতিটি ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব সরকার রয়েছে। ভারতে কেন্দ্রের ন্যায়
অঙ্গরাজ্যগুলিতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ
সকল ভারতীয় অঙ্গরাজ্যে রাষ্ট্রগঠনের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি বিদ্যমান।

(4)
সার্বভৌমত্ব :
রাষ্ট্রের চতুর্থ ও সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সার্বভৌমত্ব।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, সার্বভৌমত্ব হল আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। পশ্চিমবঙ্গসহ কোনো
ভারতীয় অঙ্গরাজ্যেরই সার্বভৌমত্ব নেই।

     যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের অধীনে থেকে অঙ্গরাজ্যগুলিকে
শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়। জরুরি অবস্থা ঘােষিত হলে কেন্দ্রীয় আইনসভা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত
যে-কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। তা ছাড়া সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারা অনুযায়ী, কোনো
অঙ্গরাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সুরকার
ভেঙে দিয়ে যাবতীয় ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে পারেন। যে-কোনো অঙ্গরাজ্যের নাম, সীমানা
প্রভৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতা ভারতীয় পার্লামেন্টের রয়েছে। কোনো ভারতীয় রাজ্য বিদেশি
কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে কোনো প্রকার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন
বা চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। সুতরাং, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব কোনো ভারতীয়
অঙ্গরাজ্যের নেই। আর এই কারণে বিহার, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাসহ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের
২৮টি রাজ্য বস্তুত অঙ্গরাজ্যমাত্র, এদের কোনোভাবেই রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা যায় না।


2. সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কি একটি রাষ্ট্র?

পর্যালোচনা:
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ রাষ্ট্র নয়, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ হল একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। আপাতদৃষ্টিতে
রাষ্ট্রের কিছু বৈশিষ্ট্য এর মধ্যে লক্ষ করা গেলেও একে কোনো ভাবেই রাষ্ট্র বলা যায়
না। রাষ্ট্রের আইন, শাসন ও বিচারবিভাগের মতে জাতিপুঞ্জের রয়েছে সাধারণসভা, নিরাপত্তা
পরিষদ ও আন্তর্জাতিক বিচারালয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হতে গেলে
অন্য যে-তিনটি উপাদান অপরিহার্য সেগুলি জাতিপুঞ্জের নেই।

যেমন

(১)
জাতিপুঞ্জে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বলে কিছু নেই।

(২)
জাতিপুঞ্জের কোনো নাগরিক সদস্য নেই। পৃথিবীর কতিপয় সার্বভৌম রাষ্ট্র এর সদস্য।

(৩)
জাতিপুঞ্জের কোনো চরম সার্বভৌম ক্ষমতা নেই। আন্তর্জাতিক আইনকে বাস্তবায়িত করার জন্য
অথবা নিজের নীতি ও কর্মসূচিকে বলবৎ করার জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলির ওপর জাতিপুঞ্জ কোনোরকম
বাধ্যতামূলক চরম ব্যবস্থা নিতে পারে না। তা ছাড়া জাতিপুঞ্জের সদস্যপদের বিষয়টিও সম্পূর্ণরূপে
স্বেচ্ছাধীন বিষয়। রাষ্ট্রগুলি ইচ্ছা করলে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ নিতে পারে অথবা সদস্যপদ
ত্যাগ করতে পারে।

     কাজেই
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষা অনুযায়ী জাতিপুঞ্জের মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে রাষ্ট্র
বলে অভিহিত যায় না।


3. রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করো।

        রাষ্ট্র
ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য: রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।

সেগুলি
হল

(1)
প্রকৃতিগত পার্থক্য
: রাষ্ট্র একটি তত্ত্বগত ধারণা। রাষ্ট্রকে চোখে দেখা যায় না। অন্যদিকে
সরকার হল রাষ্ট্রীয় ধ্যানধারণার বাস্তব রূপ। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার যন্ত্র
হিসেবে সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভােগ করে মাত্র। এই কারণে সরকারের বিরােধিতার অর্থ
রাষ্ট্র-বিরােধিতা নয়।

(2)
সম্পূর্ণ ও অংশের পার্থক্য
:  যে চারটি অপরিহার্য
উপাদান নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয় সরকার
তার মধ্যে একটি। তাই অংশকে সমগ্র বলে মনে করলে যে ভুল
করা হয়, সরকারকে রাষ্ট্র বলে মনে করলে সেই একই ভুল করা হবে।

(3)
স্থায়িত্ব -সংক্রান্ত পার্থক্য:
 সরকারের
স্থায়িত্ব একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য, তাই সরকার ক্ষণস্থায়ী। অন্যদিকে রাষ্ট্র
হল চিরস্থায়ী। অবশ্য মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে চিরস্থায়ী বলে মেনে নিতে চাননি।

(4)
গঠন-সংক্রান্ত পার্থক্য:
আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়ােগ
করে সরকার গঠন করে। কিন্তু এইভাবে ভােট দিয়ে রাষ্ট্র গঠন করা যায় না।

(5)
বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য:
 ক্ষুদ্র বৃহৎ নির্বিশেষে
রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য অভিন্ন। রাষ্ট্রের চারটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল সরকার, জনসমষ্টি,
ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্ব। অন্যদিকে সরকারের এমন কোনো অভিন্ন বৈশিষ্ট্য নেই। সরকার কোথাও
গণতান্ত্রিক, কোথাও সমাজতন্ত্রী, কোথাও একনায়কতন্ত্রী ইত্যাদি হতে পারে। তা ছাড়া
কাঠামাের দিক থেকেও সরকার এককেন্দ্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয়, রাষ্ট্রপতি শাসিত অথবা সংসদীয়
প্রকৃতির হতে পারে।

 উপসংহার:  অধ্যাপক গার্নার জীবদেহের সঙ্গে
রাষ্ট্রের তুলনা করে বলেছেন, সরকার হল রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক। জীবদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে
মস্তিষ্কের যেমন কোনো অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সরকারের
কোনো অস্তিত্ব থাকে না।


4. রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক সংঘের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা
করো।

    রাষ্ট্র
ও সামাজিক সংঘের তুলনা: আধুনিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সংগঠনের পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক
সংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক সংঘগুলির কিছু ক্ষেত্রে
সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্য অত্যন্ত প্রকট।

>
সাদৃশ্য

(1)
সমাজবোধ:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে রাষ্ট্র ও সংঘ উভয়েই মানুষের সমাজবোধ থেকে সৃষ্ট।

(2)
শৃঙ্খলা:
রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্রীয় আইনকানুন মেনে চলতে নাগরিকরা বাধ্য হন,
অনুরূপভাবে সংঘগুলির ক্ষেত্রেও সংঘ-প্রণীত নিয়মকানুন সদস্যদের মেনে চলতে হয়।

(3)
পরিচালন:
রাষ্ট্রকে পরিচালনা করার জন্য যেমন সরকার কাজ করে, ঠিক তেমনি সংঘগুলিকে পরিচালনা
করার জন্য রয়েছে পরিচালকমণ্ডলী।

(4)
কর্তব্য:
নাগরিকরা যেরকম সুযোগসুবিধা ও অধিকার ভােগের বিনিময়ে রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য
পাল করেন, একইভাবে সংঘের সদস্যরাও সংঘের সুযোগসুবিধা ভােগের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি
কর্তব্য পালন করে থাকেন।

বৈসাদৃশ্য

(1)
সার্বভৌম ক্ষমতা
: সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী না হলে তাকে রাষ্ট্র বলা যায় না। অন্যদিকে
সংঘগুলির ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশ্ন ওঠে না।

(2)
সদস্যপদ
: কোনো ব্যক্তি একের বেশি রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারে না। অন্যদিকে সংঘগুলির
ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কোনো ব্যক্তি তার ইচ্ছা অনুযায়ী একাধিক সংঘের সদস্যপদ গ্রহণ
করতে পারে।

(3)
অধীনতা
: সামাজিক সংঘগুলি রাষ্ট্রের অধীন। সংঘগুলিকে রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে চলতে
হয়। রাষ্ট্র কিন্তু কোনো সংঘের অধীন নয়। কোনো সংঘ বেআইনি কাজ করলে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

(4)
মানবজীবনে প্রভাব
: রাষ্ট্র মানুষের জীবনের বাহ্যিক দিকটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম,
কিন্তু অন্তৰ্জীবনের বিকাশে সংঘের প্রভাব অনস্বীকার্য।

(5)
কাজের পরিধি :
রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধি শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ
থাকে। অন্যদিকে, সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিধি সারা বিশ্ব জুড়ে বিস্তৃত হতে পারে।
যেমন
রেড ক্রস, স্কাউট অ্যান্ড গাইড প্রভৃতি সংঘের কাজকর্ম ছড়িয়ে রয়েছে গোটা
পৃথিবী জুড়ে।

 উপসংহারপরিশেষে বলা যায়, মানবজীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের ক্ষেত্রে উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিক রয়েছে। রাষ্ট্র ও সামাজিক সংঘ আসলে একে অপরের পরিপূরক।


5. রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদী তত্ত্বের মূল উপাদানগুলি চিহ্নিত
করা।

     রাষ্ট্রের
উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদী তত্ব: বিবর্তনবাদী তত্ত্ব রাষ্ট্রগঠনে যে মূল উপাদানগুলিকে
তুলে ধরেছে

সেগুলি
হল

(1)
অসঙ্গলিঙ্গা:
আসঙ্গলিঙ্গা মানুষের সহজাত প্রবণতা। এই প্রবণতা আদিম মানুষকে যুথবদ্ধ
জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত করেছে। এর ফলে গঠিত হয়েছে মানবসভ্যতার প্রথম প্রতিষ্ঠান পরিবার।
কালক্রমে তা গোষ্ঠীজীবন ও সমাজজীবনে সম্প্রসারিত হয়েছে। একসময় তা রাষ্ট্রের উদ্ভবের
পথকে সম্প্রসারিত করেছে।

(2)
রক্তের সম্পর্ক:
রাষ্ট্রগঠনের অন্যতম প্রাথমিক উপাদান হল রক্তের সম্পর্ক। রক্তের সম্পর্কের
ওপর ভিত্তি করে পারিবারিক তথা আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। ম্যাকাইভারের মতে, আত্মীয়তার
বন্ধনের সূত্রেই গড়ে ওঠে সমাজ এবং পরবর্তীকালে সমাজ থেকে সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের।

(3) ধর্ম: সামাজিক সংহতির শক্তিশালী হাতিয়ার ধর্ম। ধর্ম মানুষকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করে।
গােষ্ঠীজীবনের সংকটকালে ধর্ম সমাজজীবনকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করে বলে বিবর্তনবাদীরা
মনে করেন। এর ফলে রাষ্ট্রগঠনের পথ প্রশস্ত হয়।

(4)
যুদ্ধ:
বিবর্তনবাদ অনুসারে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে এক উপজাতি গোষ্ঠী নিজেদের
দলপতির নেতৃত্বে অন্য উপজাতিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এভাবে একজন বিজয়ী দলপতি
পরবর্তীকালে রাজার স্বীকৃতি অর্জন করেন।

(5)
অর্থনৈতিক চেতনা:
অর্থনৈতিক চেতনা রাষ্ট্রগঠনের অন্যতম উপাদান। পশুপালনের যুগে যখন
ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ঘটে তখন সমাজে ধনবৈষম্য দেখা দেয়। এর ফলে চৌর্যবৃত্তি,
অসাধুতার জন্ম হয়। তথ্য সামাজিক শৃঙ্খলা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে মানুষ
রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য উদ্যোগী হয়।

(6)
রাজনৈতিক চেতনা:
অর্থনৈতিক চেতনার হাত ধরে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও প্রাণরক্ষার তাগিদে নিজ দলপতির প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য একসময়
নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিবর্তনের পথ ধরে রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দেয়।

 উপসংহার: বিবর্তনবাদ অনুসারে এভাবে বিভিন্ন উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফলেই একসময়ে রাষ্ট্রের
উদ্ভব ঘটে।

6. রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ে বলপ্রয়োগ তত্ত্বের মূল বক্তব্য আলোচনা করো।

রাষ্ট্রের
উৎপত্তি সম্পর্কে বলপ্রয়োগ মতবাদ:

 মূল বক্তব্য: বলপ্রয়ােগ মতবাদের মূল বক্তব্য হল, রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে শুধুমাত্র
বলপ্রয়োগের ভিত্তিতে। পাশবিক বল বা বাহুবলই হল রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। মানবসভ্যতার
আদি ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতে মানবসমাজ ছিল বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােষ্ঠী,
দল ও উপজাতিতে বিভক্ত। প্রাথমিক অবস্থায় কোনো শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তি বা
দলের ওপর পাশবিক বলের সাহায্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এইভাবে সৃষ্টি হয় গােষ্ঠীর।
পরবর্তীকালে দুর্বল গোষ্ঠীর ওপর শক্তিশালী গোষ্ঠীর প্রভুত্ব স্থাপনের ফলে উপজাতির সৃষ্টি
হয়। এর পর কোনো শক্তিশালী উপজাতি যখন দুর্বল উপজাতিগুলির ওপর বলপ্রয়ােগের সাহায্যে
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় তখন বিজয়ী উপজাতি তাদের দলপতিকে শাসনকর্তারূপে
স্বীকৃতি দেয়। কালক্রমে দলপতির শাসনে এক-একটি এলাকায় রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, এবং দলপতি
নিজে রাজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই কারণে ফরাসি দার্শনিক’ভলতেয়ার মন্তব্য করেন,
‘প্রথম যিনি রাজা হন তিনি ছিলেন একজন সৌভাগ্যবান যোদ্ধা। বলপ্রয়োগ মতবাদ রাষ্ট্রের
প্রকৃতি সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তাতে দেখা যায় রাষ্ট্রের অস্তিত্বের স্বার্থেও
শক্তি বা

বলপ্রয়োগ
অপরিহার্য।

 সমালোচনা: 

   রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বলপ্রয়ােগ
মতবাদটি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে।

(1)
একপেশে ধারণা:
রাষ্ট্রের উৎপত্তির পিছনে বলপ্রয়ােগ ছাড়া ধর্ম, রাজনৈতিক চেতনা, সমাজ
প্রবণতা ইত্যাদিরও সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।

(2)
জনগণের সম্মতি রাষ্ট্রের ভিত্তি
: ইতিহাসে দেখা গেছে, শুধুমাত্র বলপ্রয়ােগের দ্বারা
রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখা যায়নি। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনই হল রাষ্ট্রের
প্রধান ভিত্তি। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্রিনের মতে, জনগণের সম্মতি হল রাষ্ট্রের ভিত্তি,
পাশবিক বল নয়।

(3)
আনুগত্যের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা:
জনগণ শুধুমাত্র রাষ্ট্রশক্তির ভয়ে আইন মেনে চলে
একথা ঠিক নয়। রাষ্ট্রের প্রতি জনগণ স্বেচ্ছায় আনুগত্য প্রদর্শন করে, ভয় বা ভীতিতে
নয়।

(4) স্বৈরাচারের সমর্থক: অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষার ব্যাপারে বলপ্রয়োগকে
একান্ত অপরিহার্যরূপে আখ্যা দিয়ে এই মতবাদ দেশে স্বৈরতন্ত্রের পথ সুগম করে।

(5) সভ্যতাবিরোধী: এই মতবাদ সভ্যতার পশ্চাদগতির সহায়ক, মতবাদটি সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদেরও
সহায়ক। তা ছাড়া, এই মতবাদ হল অগণতান্ত্রিক এবং সর্বোপরি বিশ্বশান্তির বিরোধী।

7. হবস্ কীভাবে প্রাকৃতিক অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন?

   হবসের বর্ণনায় প্রাকৃতিক অবস্থা: রাষ্ট্রের উৎপত্তি
সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তি মতবাদের অন্যতম মূল বক্তব্য হল, মানব-ইতিহাসে এমন একটা সময়
ছিল যখন রাষ্ট্র ও সরকার বলে কিছু ছিল না। সেই সময়ে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনারও
উদ্ভব হয়নি। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক চেতনাবিহীন এই অবস্থাকে চুক্তি মতবাদীরা প্রাকৃতিক
অবস্থা (State of Nature) বলে অভিহিত করেন। প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ যেসব বাধাবিপত্তির
সম্মুখীন হয়েছিল তা দূর করার লক্ষ্যেই পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে আদিম মানুষ রাষ্ট্রগঠনে
উদ্যোগী হয়েছিল বলে তিনজন চুক্তিবাদী রাষ্ট্র-দার্শনিক (হ, লক ও বুশো) অভিমত ব্যক্ত
করেছেন।

    ইংরেজ রাষ্ট্র-দার্শনিক হব তাঁর লেভিয়াথান
(Leviathan) গ্রন্থে (১৬৫১) এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, প্রকৃতির রাজ্যে অশান্তি ও সংঘাত
ছিল দৈনন্দিন ঘটনা। মানুষ ছিল প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর, লােভী, ধূর্ত, নিষ্ঠুর ও কলহপ্রিয়।
এই সময় কোনো আইন বা সংগঠন না থাকায় প্রত্যেকে ছিল প্রত্যেকের শত্রু। প্রাক্-সামাজিক
এই অরাজক অবস্থায় যে যাকে খুশি মারত এবং যা পেত তাই লুঠ করে নিত। কেউ কাউকে বিশ্বাস
করত না, একে অন্যকে নিছক স্বার্থের কারণে আঘাত করতে দ্বিধা করত না। এই ধরনের দুবির্ষহ
অবস্থাকে হব সকলের সঙ্গে সকলের লড়াই
বলে বর্ণনা করেছেন। আদিম মানুষের পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাত
ও প্রতিযােগিতার কারণে প্রকৃতির রাজ্য শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবেই
এই ধরনের অসহনীয় পরিবেশে মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ‘নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, ঘৃণ্য, পাশবিক ও
ক্ষণস্থায়ী (“Solitary, poor, nasty, brutish and short’) !

     দুঃসহ এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ উদ্যোগী
হয়। তারা বুঝতে পারে যে, তাদের চেয়ে শক্তিশালী কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠীর কাছে
তারা সকলে মিলে আত্মসমর্পণ করলে এই ধরনের অরাজকতার অবসান ঘটবে, তাদের জীবনে শান্তি
ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এই ধরনের চিন্তাভাবনারই ফসল হল আদিম মানুষের পারস্পরিক চুক্তির
মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠন। হবসের মতে, এই চুক্তির মাধ্যমে আদিম মানুষ নিজেদের সমস্ত ক্ষমতা
নিঃশর্ত ও চূড়ান্তভাবে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে সমর্পণ করে। এই
সার্বভৌম ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদকে হ বলেছেন ‘লেভিয়াথান।


Download Pdf

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top