গ্রাম
বাংলার সহজ সাধারণ চিরকালের চেনা ছবিকে রূপে রঙে রসে অসাধারণ করে তোলার শৈল্পিক ক্ষমতা
ছিল জীবনানন্দ দাশের । “শিকার “কবিতার নানা দৃশ্যপট রচনায় তার প্রমাণ মেলে।
শিকার কবিতায় ভোরের দৃশ্য রচনা করতে গিয়ে কবি চেয়ে দেখেছেন নীল আকাশের দিকে।তখন যদিও প্রভাত আলোর গভীরে
আশ্রয় নিয়েছে নক্ষত্ররা।তবুও একটি তারা তখনও আকাশে বিদ্যমান। এই একটি তারা কে নিয়ে
কবি তার ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন কাব্যিক ভাষায়।
নীল আকাশের
প্রেক্ষাপটে তারাটির একাকীত্ব অবস্থান এবং তার প্রকৃতিকে প্রকাশ করতে কবি দুটি সার্থক
উপমা প্রয়োগ করেছেন। প্রথমটি হলো-
“পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি মদির মেয়েটির
মত”।
এই উপমাটির
সাহায্যে কবি জড়বস্তুর মধ্যেই
সৃষ্টি করেছেন মানবিকঅনুভূতি। পাড়াগাঁর বাসরঘরে গোধূলিমদির মেয়েটির একাকিত্বের সাথে
কবি তারাটির একাকীত্বকে মিলিয়ে দিয়েছেন। এই তুলনার মাধ্যমে তিনি ধরে রাখতে চেয়েছেন
মেয়েটির লজ্জা আর কুন্ঠা কেও। আবার মেয়েটির আচরণের কমনীয়তার সাথে “মদির”
শব্দ দিয়ে কবি জীবনের উন্মাদনাকে মিশিয়ে দিয়েছেন।
দ্বিতীয় উপমাটিতে কবি তারাটিকে মিশরের মানুষীর বক্ষের অলংকার থেকে নেওয়া মুক্তা যা হাজার বছর আগে তার প্রণয়ীর নীল মদের গেলাসে স্থাপিত
হয়েছিল -সেই মুক্তার সঙ্গে উপমায়িত করেছেন।
“মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তা আমার নীল মদের /গেলাসে রেখেছিল”. ………
প্রথম উপমার সহজ সারল্যের পরিবর্তে দ্বিতীয় উপমাটি সজ্জিত হয় ঐতিহাসিক আড়ম্বরে।
নীল আকাশের পটভূমিতে রাতজাগা তারা আর নীল মদের গেলাসে রাখা মুক্তা মিলেমিশে একাকার
হয়ে যায়। “মিশরের মানুষী” আর “হাজার হাজার বছর আগে” শব্দবন্ধে তা স্থান-কালের সীমাকে ছাড়িয়ে সারাবিশ্বের সর্বকালীন
বিস্তৃতি পায়। কবির অতীতচারীতায় তা অনন্য হয়ে ওঠে। প্রণয়িনীর প্রেমসিক্ত হৃদয়ের
প্রীতি উপহারের সূচি শুভ্রতা ছুয়ে আছে তারাটিকে। তার মতোই তারাটি প্রেমের গভীরতায় জ্যোতিস্মান। একাকীত্বে
ধন্য। উপমা দুটি প্রয়োগে
কবির সুগভীর ভাবনার বিশিষ্টতা
চোখে পড়ে। প্রথমটি একালের। পরেরটি সুদূর অতীতের- এই কালগত ব্যবধানের বিপ্রতীপ সংশ্লেষে
উপমা দুটি ও অপূর্ব কাব্যিক সৌন্দর্য লাভ করেছে। আকাশের একটি তারা কে নিয়ে এমন ভাবনা
সাহিত্যে বিরল।