“ডাকাতের মা” সতীনাথ ভাদুড়ীর
সাহিত্যকে বলা
হয় সমাজের দর্পণ। কবি সাহিত্যিকগণ যেহেতু কোনো না কোনো সমাজের মানুষ, তাই তাঁদের দেখা
সমাজের ছবি প্রতিবিম্বিত হয়ে ওঠে তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যে। কথাসাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ী
ও তার ব্যতিক্রম নন। তাই তাঁর “ডাকাতের মা” গল্পেও সমকালীন সমাজের কয়েকটি
টুকরো ছবি ফুটে উঠেছে।
এই গল্পের সমাজচিত্র বর্ণনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় তৎকালীন সমাজে
“ডাকাত সম্প্রদায়ের” অবস্থান ও জীবন-জীবিকার কথা। ডাকাতরা সমাজের নিচু তলার
মানুষ হলেও তাদের এই ডাকাতি পেশা তাদের কাছে ছিল হকের পেশা। বংশপরম্পরায় তারা এই জীবিকা
গ্রহণ করত। সৌখীর বাবার পর সৌখীর এই বৃত্তি গ্রহণ তারই প্রমাণ। তবে ডাকাতরা ডাকাতি
করত অভাবে পড়ে। সৌখী জেলে যাওয়ার পর তার পরিবারের দুঃসহ অভাব-অনটন সে কথাই প্রমাণ
করে। ডাকাতি সমাজের চোখে গর্হিত হলেও নামজাদা ডাকাত পরিবারের এই পেশা নিয়ে গর্বের
অন্ত ছিল না। যেমন সৌখির বাবা বা সৌখীকে নিয়ে গর্ব করেছে সৌখীর মা।(“দারোগাসাহেব
পর্যন্ত যার বাপকে তুই-তোকারি করতে সাহস করেননি কোনদিন”)। এছাড়াও আমরা জানতে
পারি তখনকার ডাকাতদলের শৃংখলার কথা। আবার দিনবদলের সাথে সাথে যে অবক্ষয় সমাজকে ঘিরে
ধরেছে, ডাকাত দলের মধ্যেও সেই ন্যায়-নীতিবোধের অভাবের ছবি ও ফুটে উঠেছে গল্পটিতে।
ফুটে উঠেছে ডাকাত দলের নানা নিয়ম-কানুন ও সংকেত পদ্ধতি।
তবে শুধু ডাকাত দল নয় তখনকার আইন বিচার ব্যবস্থারও কয়েকটি চিত্র পাওয়া
যায় গল্পটিতে। যেমন তখন বড়লাট জেল পরিদর্শনে এসে জেলারের সুপারিশ অনুযায়ী কয়েদিদের “রেমিশান” দিতেন। কার্যসিদ্ধির জন্য
ঘুষ দেওয়ার রীতি ও লক্ষণীয়। যা সৌখী দিয়েছে হেড জমাদারকে।
তখনকার সমাজে কিছু সংস্কার ও প্রচলিত ছিল। যেমন – “লোটা হলো বাড়ির
লক্ষ্মী,”। তাছাড়া মাতাদীন এর মত আইন চঞ্চুলোকের অস্তিত্ব সে সমাজে ছিল।
তবে সবচেয়ে মন ছুঁয়ে যায় যে, এই ডাকাত সম্প্রদায় অপরাধী। সমাজের চোখে
তারা ঘৃণিত। তবুও তারা মানুষ। আর পাঁচটা মানুষের মতো তাদের মধ্যেও আছে মাতৃত্ব, সন্তানস্নেহ,
পত্নী ও পরিবারের প্রতি ভালোবাসা- এ চিত্র ও লেখক ফুটিয়ে তুলতে ভোলেননি। এভাবেই গল্পটিতে
এক ভিন্নতর সমাজের ছবি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে গল্পকারের নিপুণতায়।