ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মুদ্রার গুরুত্ব
প্রাচীনকালের
ইতিহাস রচনার উপাদানগুলির মধ্যে সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার একটি অন্যতম উপাদান হল মুদ্রা। সেসময় সোনা, রুপা, তামা,
সিসা প্রভৃতি ধাতুর মুদ্রা নির্মিত হত। মুদ্রার গুরুত্বগুলি হল-
(১)
রাজার পরিচয় জানতে: কোনো রাজার মুদ্রা
থেকে সেই রাজার নাম, বংশ পরিচয় প্রভৃতি জানা যায়। এইসব তথ্য ইতিহাসের দিক থেকে বিশেষ
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
(২)
সময়কাল নির্ণয়ে: মুদ্রায় উল্লিখিত সন-তারিখ
থেকে রাজাদের সিংহাসনে আরােহণ, বিশেষ কোনো স্মরণীয় ঘটনা, রাজত্বকাল ইত্যাদি সম্পর্কে
জানা যায়।
(৩)
ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে জানতে: প্রাচীনকালে
অনেক সময় রাজার ধর্মই যেহেতু প্রজার ধর্ম ছিল, তাই মুদ্রায় খোদিত দেবদেবীর মূর্তি
বা কোনো প্রতীক রাষ্ট্রীয় ধর্মবিশ্বাসের তথ্য প্রদান করে থাকে।
(৪)
অর্থনৈতিক মান নির্ণয়ে: মুদ্রায় ধাতুর
ব্যবহার থেকে সে-যুগের অর্থনৈতিক অবস্থার আভাস পাওয়া যায়।
(৫)
রাজ্যসীমা সম্পর্কে ধারণা পেতে: মুদ্রার
প্রাপ্তিস্থান থেকে রাজার রাজ্যসীমার পরিচয় পাওয়া যায়। অবশ্য মুদ্রা সহজেই স্থানান্তরযোগ্য
বলে এবিষয়ে কিছু সমস্যা থেকেই যায়।
(৬)
তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ে: ঐতিহাসিক
তথ্যের সত্যতা যাচাই করার ক্ষেত্রে মুদ্রা বিশেষ ভূমিকজ পালন করে থাকে। কোনো মুদ্রা
সমকালীন সাহিত্য বা লিপির তথ্যকে সমর্থন করলে সেই তথ্য আরও বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে
করা হয়।
(৭)
শিল্পকলা সম্পর্কে জানতে: মুদ্রা থেকে
সে যুগের ধাতুশিল্প ও অন্যান্য শিল্পকলার পরিচয় পাওয়া যায়। মুদ্রায় আঁকা ছবি থেকে
সেই সময়কার শিল্পের উৎকর্ষের মূল্যায়ন করা সম্ভব।
(৮)
ভাষা ও লিপি সম্পর্কে জানতে: মুদ্রায়
ব্যবহৃত ভাষা, লিপি প্রভৃতি থেকে সেই যুগের ভাষাগত নানা তথ্য পাওয়া যায়। দেশের রাষ্ট্রীয়
ভাষা বা লেখার মাধ্যম কী ছিল তা মুদ্রা থেকেই জানা যায়।
(৯) একমাত্র
ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে: কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুদ্রাই কোনো যুগের ব্যাকট্রীয় শাসক
মিনান্দারের স্বর্ণমুদ্রা একমাত্র ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে থাকে। ভারতে ত্রিশজন ব্যাকট্রীয় গ্রিক রাজার পরিচয় জানার জন্য মুদ্রা ব্যতীত
অন্য কোনো উপাদান নেই।
(১০) অবিকৃত
উপাদানরূপে: ইতিহাসের অনেক জৈব উপাদান প্রাকৃতিক কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু
ধাতব মুদ্রাগুলি পোকা-মাকড় বা প্রাকৃতিক কারণে নষ্ট হয় না বলে প্রাচীনকালের অনেক
তথ্য অবিকৃতভাবে মুদ্রা থেকে পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
(১১)
অধিক
ঐতিহাসিক মূল্য: দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন
প্রাচীন সাহিত্যে যেমন পরিবর্তন, কনিষ্কের স্বর্ণমুদ্রা সংযোজন বা বিয়োজন ঘটতে পারে,
মুদ্রার ক্ষেত্রে তেমনটি সম্ভব নয়। তাই কোনো যুগের তথ্য হিসেবে মুদ্রার ঐতিহাসিক মূল্য
বেশি।
উপসংহার: যেখানে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদানের স্বল্পতা
রয়েছে, সেখানে মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। আবার অন্যান্য
উপাদানের সত্যতা যাচাইয়ের কাজেও মুদ্রা সহায়কের দায়িত্ব পালন করেছে। তাই প্রাচীন
মুদ্রার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এই সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন,
মুদ্রা রাজাদের নাম ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের শাসনকার্য সম্পর্কে জানতে যথেষ্ট সাহায্য করে।