প্রাচীন মিশরের পিরামিড স্থাপত্য শৈলির উদ্ভব ও বিবর্তন লেখ | পিরামিড স্থাপত্য | B.A Semester-1 History Note |
পিরামিড স্থাপত্য শৈলি
উদ্ভব
মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল- মানুষের
দেহের মমিকরন এবং পিরামিড স্থাপত্য। বস্তত মিশরের চিন্তা-চেতনা মূলত আবর্তিত হয়েছে
মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে রহস্যকে কেন্দ্র করে। তবে পিরামিড স্থাপত্য সরাসরি মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসের
সঙ্গে সংযুক্ত নয়। মিশরের মমিকরন ও পিরামিড সংস্কৃতি ছিল ওসিরীয় অর্চনা গোষ্ঠীর অন্তর্গত।
মিশরের রাজবংশ গুলি এবং অধিকাংশ অভিজাত ও সাধারণ মানুষ প্রায় সকলেই এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত
ছিল। এদেরকে কেন্দ্র করে পিরামিড স্থাপত্য আবর্তিত হয়েছিল।
সাধারণত মিশরীয়রা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। তারা শরীরকে
অত্যন্ত প্রাধান্য দিত। তাই মৃত্যুর পরেও শরীরকে অবিকৃত রাখার প্রচেষ্টা তারা আপ্রান
ভাবে করতো। মূলত মিশরের মরুভূমি অঞ্চলের জলবায়ু এজন্য অনেকখানি দায়ী ছিল। মিশরীয়রা
সাধারণত মরুভূমি অঞ্চলে মৃতদেহ সমাধিস্থ করতো।
মরুভূমির শুষ্ক বালুকাময় মাটিতে মৃতদেহের পচন অনেক দেরিতে হওয়ার বহুদিন পর্যন্ত
মৃতদেহ অনেকটা অবিকৃত থাকতো। এখান থেকে সম্ভবত মৃত্যু পরবর্তী অবিকৃত নিরবচ্ছিন্ন জীবনের
ধারণা গড়ে উঠেছিল এবং মৃতদেহকে সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। ক্রমে তারা মমিকরনের মতো বিস্ময়কর
মৃতদেহ সংরক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।
বিবর্তন
পিরামিড স্থাপত্যশৈলী নির্মাণের পূর্বে মিশরের এক ধরনের সমাধি সৌধের কথা জানা যায়, যেগুলি
‘মাস্তাবা’ আরবি অর্থাৎ বেঞ্চ নামে পরিচিত। এ ক্ষেত্রে মাটির তলায় থাকতো কবর, আর মাটির
উপরে কাদামাটির ইটের সৌধ বানানো হতো। তবে পরবর্তীতে এর আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটেছিল।
সিঁড়ি পিরামিডসিঁড়ি পিরামিড
মিশররাজ জোসার এবং তার স্থাপতি ইমহোটেপ প্রথম প্রচলিত মাস্তাবার গঠনের পরিবর্তন
নিয়ে আসেন। ইমহোটেপ ছিলেন একজন বিখ্যাত সৌধ নির্মাতা। তার খ্যাতি সামগ্র মিশর তথা
গ্ৰিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইমহোটেপ ‘সাকারায়’ একটি বিশাল
সমাধি-সৌধ নির্মাণের সময় সেখানে উপর-নীচ করে ক্রমান্বয়ে তিনটি মাস্তাবা নির্মাণ
করেছিলেন পরবর্তীতে এই সৌধের কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে 6 টি মাস্তাবা বা ধাপ যুক্ত একটি
স্থাপত্যে পরিণত করেন। এই ধাপগুলি দেখতে অনেকটা
সিঁড়ির মতো বলে একে ‘সিঁড়ি পিরামিড’ বা স্টেপ পিরামিড বলা হয়। আবার অনেকগুলি ধাপের সমন্বয়ে এই পিরামিড গঠিত হয়
বলে একে ধাপ পিরামিডও বলা হত।
বৈশিষ্ট্য
স্টেপ পিরামিড
Step pyramid এর
উচ্চতা 60 মিটার বা পিরামিডের ভিতরের আয়তন 140 ×118 মিটার Step pyramid এর ভেতরে আরও
কয়েকটি স্থাপত্য ও মন্দিরের পাশাপাশি জোসারের স্ত্রী ও পুত্রদের সমাধিও নির্মিত হয়েছিল।
Step pyramid নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণ ইটের পরিবর্তে চুনাপাথরের প্রয়োগ দেখা যায়।
Step pyramid এর চারদিকে 10 মিটার উঁচু এবং 1.7 কিমি লম্বা প্রাচীর দ্বারা ঘেরা ছিল
এবং অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য 14 টি প্রবেশপথ ছিল। এই শৈলি মিশরের পিরামিড স্থাপত্য
রীতিকে সম্পূর্ণ নতুনত্ব প্রদান করেছে।
প্রকৃত পিরামিড
পিরামিড
নির্মাণের ক্ষেত্রে স্টেপ পিরামিডের মাধ্যমে বহু পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হলে স্নেফেরুর শাসন কাল থেকে মিশরে প্রকৃত পিরামিড নির্মিন হয়।
এধরনের পিরামিডের ধ্বংসাবশেষ মেইদামে পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রেও চুনাপাথরের ব্যবহার
ঘটলেও সেগুলি শৌখিনতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই পিরামিডের উচ্চতা 93.5 মিটার এবং তলদেশের
147 মিটার লম্বা।
রেড পিরামিড ও
বেন্ট পিরামিড
মিশররাজ স্নেফেরূর তৈরি পিরামিডের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ ছিল-Red piramid।
বর্তমান কায়রোর 40 কিমি কিমি দক্ষিণে অবস্থিত
দহশুর নামক স্থান থেকে এই পিরামিড নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে। এখানে রাজার সমিধি
ছিল। তাছাড়াও দহশুর থেকে বেন্ট পিরামিডের নির্দেশন আবিষ্কাত হয়েছে। তবে নরম বাড়ি
মাটির উপর এই পিরামিড নির্মাণের জন্য এটি ঝুঁকে পরেছিল। ফলে উচ্চতা কমানোর জন্য বাইরের কৌণিক মাপ 54 কোন থেকে 43 কোনে নামিয়ে আনা হয়েছিল। আর
এই ঝুঁকে পড়ার জন্য এই পিরামিডকে বেন্ট পিরামিড বলা হত।
গ্রেট পিরামিড
মিশররাজ খুফুর সময় কালে মিশরের
সবচেয়ে বৃহত্তম পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। খুফুর কায়রোর পশ্চিমে গির্জা মালভূমির উপর
এক বৃহদাকার পিরামিড নির্মান করেন এই পিরামিডই
‘গ্ৰেট পিরামিড’ নামে পরিচিত ছিল। এই পিরামিড নির্মানের 25 লক্ষ কিউবিক মিটার
পাথর ব্যবহৃত হয়েছিল। এক্ষেত্রে চুনাপাথরের
পরিমাণ ছিল 2.3 মিলিয়ন তলদেশে 2.3 মিলিয়ন। এই পিরামিডের উচ্চতা ছিল -146.6মি. এবং
তলদেশ 230 মি. লম্বা। মোট 5.3 হেক্টর জায়গা জুড়ে এই পিরামিড অবস্থান করতো।
পরবর্তীকালে আরও বহু পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। খুফুর ছেলে জেদাফরে গিজার
উত্তর দিকে একটি পিরামিড তৈরি করেছেন। তার পরবর্তী শাসক কেপলরেন ও দ্বিতীয় বৃহত্তম পিরামিড নির্মাণ করেন
যার উচ্চতা 14 3.5 মি. এবং দৈর্ঘ্য 215মি.
এছাড়াও ফ্যারাও মেনকাওরা 65 মি. উচ্চতা
বিশিষ্ট একটি পিরামিড নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে খননকার্যের মাধ্যমে গিজার মালভূমিতে
পাহাড় কেটে তৈরি যাবার উপর ভর করা একটি সিংহ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, যার উচ্চতা 170 ফুট এবং দৈর্ঘ্য
150 ফুট।
বস্তুত পিরামিড হলো একধরনের ত্রিভুজাকার পাথর দ্বারা তৈরি সমাধি স্থাপত্য।
মূল গর্ভগৃহ ছাড়াও পিরামিডের একাধিক কক্ষ থাকতো এবং অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য গোপন
পথ ও ছিল। তবে পিরামিডের স্থাপত্যগত জটিলতার জন্য সম্পূর্ণ স্থাপত্যের পরিকল্পনা কখনও
পুরোপুরি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে এক্ষেত্রে সময় ও শ্রমশক্তি যে অনেক বেশি প্রয়োজন
হতো সেকথা অস্বীকার করা যায় না। প্রাথমিক পর্বে পিরামিড নির্মাণের যে রীতি ও গঠন প্রচলিত ছিল, পরবর্তীকালে বিভিন্ন
মিশরীয় রাজা পৃষ্ঠপোষকতায় তা পরিণত ও বৃহত্তর রূপ লাভ করে।