রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা
করো।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান
পাঠের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি:
উদ্ভব
রাষ্ট্রের কার্যাবলি এবং প্রকৃতি-সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল উদারনৈতিক মতবাদ।
সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসন ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডে
সপ্তদশ শতাব্দীতে উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে।
মূল বক্তব্যঃ– উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্য হল ব্যক্তির জন্যই রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্রের
অস্তিত্ব ব্যক্তির জন্যে, ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্যে নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের
সাধারণ অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা।
উদারনীতিবাদের ধারাঃ– রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা উদারনীতিবাদের তিনটি ধারার কথা
বলেন। সেগুলি হল—
[1]
চিরাচরিত বা সাবেকি উদারনৈতিক মতবাদ (Classical Liberal theory), [2] আধুনিক বা সংশোধিত
উদারনৈতিক
মতবাদ
(Modern Liberal theory) এবং [3] নয়া উদারনীতিবাদ (Neo-Liberalism)।
1. সাবেকি
উদারনৈতিক মতবাদ : সাবেকি উদারনৈতিক মতবাদের মূল বক্তব্য হল—
(i) রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সম্পর্ক চুক্তিভিত্তিক : সাবেকি উদারনীতিবাদে বলা হয় যে জীবন, স্বাধীনতা
ও সম্পত্তির অধিকারের মতো ব্যক্তির প্রাকৃতিক অধিকারগুলি রক্ষার উদ্দেশ্যে চুক্তির
মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে। এই কারণে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক পুরোপুরি
চুক্তিগত।
(ii) রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক : লকের মতে, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের মূলভিত্তি।
রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জনগণের কল্যাণসাধনের ওপরে নির্ভরশীল। সাবেকি উদারনীতিবাদের প্রধান
প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সংরক্ষিত করার জন্যই রাষ্ট্রের
প্রয়োজন।
(iii) রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সর্বাধিক ব্যক্তির
সর্বাধিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান :
বেন্থামের মতে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের
ব্যবস্থা করা। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্র একটি আইন প্রণয়নকারী সংস্থা ছাড়া আর কিছু
নয়।
2.
আধুনিক উদারনৈতিক মতবাদ: এই মতবাদ অনুযায়ী-
(1) রাষ্ট্র সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ : ইংল্যান্ডের ভাববাদী দার্শনিক টি. এইচ. গ্রিন বলেন,
জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, বলপ্রয়োগ নয় (“Will, not force, is the
basis of the state”)। গ্রিন রাষ্ট্রকে সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ বলে বর্ণনা করেন।
(ii) রাষ্ট্র সমাজের প্রতিনিধি : অধ্যাপক ম্যাকাইভারের মতে, রাষ্ট্র জনগণের সেবা করে
বলেই তার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্র জনগণ অপেক্ষা বড়াে হতে পারে না।
ম্যাকাইভার ধর্ম, নৈতিকতা, প্রথা ও সংস্কৃতির উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন।
(iii) রাষ্ট্র একটি জাতীয় সমাজ : অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি রাষ্ট্রকে একটি জাতীয়
সমাজ বলে অভিহিত করেন। ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্রকে সমাজথ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ
করতে হয়। জনগণের ব্যাপক অংশের সর্বাধিক পরিমাণ সামাজিক মঙ্গলসাধন রাষ্ট্রের প্রধান
কাজ।
3.
নয়-উদারনীতিবাদঃ- নয়া-উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্য হল—
(i) ন্যুনতম রাষ্ট্র : নয়া-উদারনীতিবাদে রাষ্ট্রের ভূমিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
করা হয়। তবে এই রাষ্ট্র কোনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান বা স্বৈরী প্রতিষ্ঠান নয়।
নয়া-উদারনীতিবাদের রাষ্ট্র হল ন্যূনতম রাষ্ট্র(Minimal State)।
(ii) রাষ্ট্রের সীমিত কাজ : নয়া-উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের ন্যূনতম কাজের কথা বলে।
এই মতবাদ অনুযায়ী নিরাপত্তা রক্ষা (Protection), ন্যায়বিচার (Justice) এবং প্রতিরক্ষামূলক
(Defence) কাজ ছাড়া রাষ্ট্রের আর-কোনাে কাজ থাকতে পারে না। রাষ্ট্র অত্যন্ত দক্ষতার
সঙ্গে নাগরিকদের ন্যায়সংগতভাবে অর্জিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করবে।
(iii) মুক্ত অর্থনীতি : সাবেকি উদারনীতিবাদের অবাধ বাণিজ্য
(Laissez-faire) নীতির পুনরুজ্জীবনের পক্ষপাতী। নয়া-উদারনীতিবাদের বক্তব্য অনুসারে,
ব্যক্তিকে প্রকৃত উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছোতে হলে তার অর্থনৈতিক জীবনকে সর্বপ্রকার
নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে হবে। নয়া-উদারনীতিবাদে মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে (Free
Market Economy) স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
উপসংহা:- উদারনীতিবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার
করা যায় না। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে নয়া-উদারনীতিবাদের একটি স্বতন্ত্র তাৎপর্য
রয়েছে।