রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ঐশ্বরিক মতবাদটি বিশ্লেষণ করো অথবা রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক উৎপত্তি মতবাদের মূল যুক্তিগুলি লেখো | Class Xi Politicat Science PDF |


রাষ্ট্রের
উৎপত্তি-ঐশ্বরিক মতবাদ:

 মূল বক্তব্য: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে যেসব কাল্পনিক মতবাদ চালু রয়েছে তার মধ্যে
প্রাচীনতম হল ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ। সেন্ট অগাস্টাইন, সেন্ট পল, রবার্ট ফিলমার হলেন এই
মতবাদের প্রচারক।

এই
মতবাদের মূল বক্তব্য হল :-

(1)
ঈশ্বর নিজে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।

(2)
পৃথিবীতে ঈশ্বরের মনোনীত প্রতিনিধি হলেন রাজা। ঈশ্বরের যাবতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছা রাজার
মাধ্যমে কার্যকরী হয়।

(3)
রাজার আদেশ যা আইনরূপে পরিচিত তা আসলে ঈশ্বরের আদেশমাত্র। কাজেই রাজার আদেশ অমান্য
করার অর্থ হল ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করা।

(4)
রাজা যেহেতু ঈশ্বরের নির্দেশ ছাড়া অন্য কারও নির্দেশে কাজ করেন না, তাই রাজা কোনোরকম
অন্যায় করতে পারেন না। (5) রাজা তাঁর যাবতীয় কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে
দায়বদ্ধ থাকেন। রাজার কাজকর্মের জন্য জনগণ কোনোভাবেই কৈফিয়ত চাইতে পারেন না।

(6)
রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করার অর্থ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

(7)
রাজা যেমন ঈশ্বরের অধীন, প্রজারাও তেমনি রাজার অধীন।

(৪)
সেন্ট পল-এর মতে, রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন হল ঈশ্বর কর্তৃক আরােপিত কর্তব্য।

(9)
রাজা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজপদে আসীন হন
এই বিধানটিও ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট। এইভাবে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ
রাজতন্ত্রকে ঈশ্বর সৃষ্ট একমাত্র সুশাসন হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: ইউরোপে মধ্যযুগে ষোড়শ শতাব্দীতে ও সপ্তদশ শতাব্দীর
প্রথমভাগে পোপ নিজেকে ঈশ্বরের এক এবং অদ্বিতীয় প্রতিনিধিরূপে পরিচয় দিয়ে জনগণের
অখণ্ড আনুগত্য দাবি করেন। মার্টিন লুথার, ক্যালভিন প্রমুখ প্রোটেস্টান্ট নেতৃবৃন্দ
রাজাকে ঈশ্বরের একমাত্র প্রতিনিধিরূপে তুলে ধরে জোরালো আন্দোলন করেন। ইংল্যান্ডের রাজা
প্রথম জেমস ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে রাজার অধীন রাষ্ট্রকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান
হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে ঈশ্বরের জীবন্ত প্রতিমূর্তি হলেন রাজা। এইভাবে
ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ এক চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। ষোড়শ শতাব্দীর পরবর্তীকালের
পরিবর্তিত পরিস্থিতি ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের অবসানের পথ প্রশস্ত করে।

সমালোচনা: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের ব্যাখ্যাকে
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা হয়-

1. অবাস্তব: সমালোচকদের মতে, ঐশ্বরিক কোনো শক্তির দ্বারা রাষ্ট্রের
সৃষ্টি হয়েছে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। রাষ্ট্রের উৎপত্তি-সম্পর্কিত বাস্তবভিত্তিক
যুক্তিগ্রাহ্য ধারণা এই মতবাদে উপেক্ষিত। রাষ্ট্রের মতো একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠান কীভাবে
ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হতে পারে তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ দিতে
পারেনি।

2. অনৈতিহাসিক: রাষ্ট্র ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট এবং রাষ্ট্রের কর্ণধার
রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি
ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের এই মূল বক্তব্যের সমর্থন ইতিহাসে
কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং, ঈশ্বরের ইচ্ছার ফলে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে এরকম
ধারণা পুরোপুরি অনৈতিহাসিক।

3. অযৌক্তিক:  সমালোচকদের
মতে, ঈশ্বর করুণাময়, মানুষের কল্যাণে তিনি সদাজাগ্রত, তাই তাঁর প্রতিনিধি রাজা সর্বদা
প্রজাদের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবেন
এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। বাস্তবে কিন্তু বহু অত্যাচারী
ও প্রজা নিপীড়নকারী রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। এই ধরনের অত্যাচারী রাজার কাজকে ঈশ্বরের
ইচ্ছার অভিব্যক্তি বলে ধরে নিলে পরম করুণাময় ঈশ্বরের ধারণা কালিমালিপ্ত হতে বাধ্য।

4. অসম্পূর্ণ:  শুধুমাত্র
রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেই এই মতবাদ প্রযােজ্য, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনো ধরনের
শাসনব্যবস্থার উৎপত্তির প্রসঙ্গে এই মতবাদের আলোচনা গ্রহণযােগ্য নয়। তাই এই মতবাদ
অসম্পূর্ণ।

5. অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী:  রাজা যেহেতু
ঈশ্বরের একমাত্র প্রতিনিধি তাই রাজার আদেশ সমস্ত সমালোচনার উর্ণে
এই ধরনের
যুক্তি স্বৈরাচারের জন্ম দেয়। তা ছাড়া, এই মতবাদে রাজাকে তার কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র
ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে। তিনি আর কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন।
এই মতবাদ

রাজাকে
আইনের উর্ণে স্থাপন করে অগণতান্ত্রিকতা ও স্বৈরাচারিতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে।

6. রক্ষণশীল: ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ একটি রক্ষণশীল মতবাদ। রাজা যদি
অন্যায় আচরণ করেন সেক্ষেত্রেও প্রজাদের কোনো বিরোধিতার অধিকার এই মতবাদে স্বীকার করা
হয়নি।

7. নাস্তিকদের আনুগত্যহীনতা: যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তারা রাষ্ট্রকে
ঈশ্বরসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি
আনুগত্য দেখাতে পারে। কিন্তু যারা নাস্তিক বা ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী তারা ঐশ্বরিক
প্রতিষ্ঠান স্বরূপ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখাবে না। ফলে জনগণের এক অংশ রাষ্ট্রের
আনুগত্য না দেখালেরাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।

উপসংহার:  ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের
উপরিউক্ত কঠোর সমালােচনা সত্ত্বেও তত্ত্বটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা
যায় না। অধ্যাপক গেটেলের মতে, স্বায়ত্তশাসনের জন্য মানুষ যখন আদৌ যোগ্য হয়ে ওঠেনি
তখন এই মতবাদ আনুগত্যের শিক্ষা দিয়েছিল (‘It taught men to obey when they were
not yet ready to govern themselves’) তাছাড়া, রাষ্ট্র সৃষ্টির পিছনে অন্যান্য উপাদানের
পাশাপাশি ধর্মের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে তা ঐশ্বরিক মতবাদে স্বীকৃত হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top