শিকার কবিতার নামকরণের সার্থকতা:-
নাম কি শুধু চেনানোর জন্য? ব্যক্তি, বস্তুর ক্ষেত্রে শুধু চেনানোই তার কাজ
হলেও সাহিত্যের নামকরণ চেনানোর সাথে সাথে সাহিত্যকর্ম টির অন্তর্নিহিত সারসত্য কে পাঠকের
সামনে স্পষ্ট করে তোলে। তাই সাহিত্যের নামকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সাহিত্যের
“অন্দরমহলে প্রবেশের চাবিকাঠি “।
সাহিত্যের নামকরণ কখনো বিষয়কেন্দ্রিক, কখনো চরিত্রকেন্দ্রিক
কখনো বা ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে থাকে ।জীবনানন্দ দাশের “শিকার “কবিতাটির নামকরণের
বিষয়বস্তুর ছোঁয়া থাকলেও তা যথেষ্ট ব্যঞ্জনা ধর্মী।
একটি অসাধারণ শান্ত
সুন্দর আরণ্যক ভোরের দৃশ্যপট রচনার মধ্য দিয়ে কবিতাটির সূত্রপাত। ঘাসফড়িঙের দেহের
মত কোমল নীল রং বিশিষ্ট ভোরের আকাশ। টিয়ার পালকের মতো সবুজ গাছগাছালি পরিবেষ্টিত ।পাড়াগাঁর
বাসরঘরের লাজুক কনে বউ অথবা মিশরের
কোন প্রেমিকার প্রণয়ীর নীল মদের গেলাসে রাখা বুকের অলংকারের একখণ্ড মুক্তার মত একটি
তারা আকাশে জ্বলছে ।শীতের রাতে উত্তাপ
পাবার আশায় দেশোয়ালিরা যে রক্তিম আগুন জ্বেলেছিল প্রভাত কিরণ সম্পাতে তা রোগা শালিকের বিবর্ণ ইচ্ছার
মতো ফ্যাকাশে ।সকালের আলোয় অরন্যের সবুজ আর
আকাশের নীল মিশে ঝিলমিল করছে ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ।
চিতা বাঘিনীর হাত থেকে আত্মরক্ষার আতঙ্কিত রাত কাটিয়ে
একটি সুন্দর বাদামি হরিণ এমনই সৌন্দর্যময় ভোরে খাচ্ছে সবুজ সুগন্ধি ঘাস। সে ক্লান্ত
বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো প্রাণস্ফূর্তিতে পূর্ণ করার জন্য নেমেছিল নদীর তীক্ষ্ণ
শীতল জলে।চেয়েছিল আপন সাহসে সাধে সৌন্দর্য্যে হরিণীদেরকে চমক লাগিয়ে দিতে।কিন্তু
অদ্ভুত একটা শব্দের সাথে সুসভ্য মানুষের গুলির আঘাতে প্রাণ দিতে হলো হরিণকে। উষ্ণ লাল
হরিণের মাংস আত্মতৃপ্ত হলো টেরিকাটা মানুষগুলোর।
কবিতাটির উক্ত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়
যে সুন্দর মনোরম আরণ্যক
পরিবেশে এক প্রাণস্ফূর্ত একরাশ আকাঙ্ক্ষা সমৃদ্ধ আরণ্যক প্রাণকে “শিকার”
করল একদল হৃদয়হীন অনুভূতিহীন সভ্য মানুষ। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে একটি শিকার এর দৃশ্য
কাহিনীতে স্থান পেয়েছে। আবার এই শিকার শুধু একটি হরিণ শিকার নয়, অরণ্য প্রকৃতির শান্তি
ও স্বাভাবিক বনশ্রী যান্ত্রিক সভ্যতার নিষ্ঠুর বর্বরতার শিকার হয়ে পড়ল -যে হিংস্রতা
চিতাবাঘিনীর চেয়ে তীব্র।আজও আমরা
এভাবেই শিকার করে চলেছি আরণ্যক শান্তি,
সৌন্দর্যও স্বাধীনতাকে- এখানেই লুকিয়ে আছে কবিতাটির নামকরণের সুগভীর ব্যঞ্জনা। তাই
শিকার কবিতাটির নামকরণটি অত্যন্ত যথাযথ, সার্থক এবং শিল্পশ্রী মন্ডিত হয়েছে।