কৃত্তিবাস ওঝার
কৃতিত্ব বা জনপ্রিয়তার কারণ
• ভূমিকা:
“কৃত্তিবাস কীর্তীবাস কবি এ বঙ্গের অলংকার”
-মধুসূদন
সংস্কৃত ভাষার শৃংখল ভেঙে “রাম কথাকে” বাঙালির প্রাণের ভাষায়
যাঁরা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বাংলা রামায়নের আদি কবি তথা শ্রেষ্ঠ কবি
কৃত্তিবাস ওঝা সর্বাগ্রগণ্য।
• গ্রন্থপরিচয়: কৃত্তিবাস ওঝা আদি কবি বাল্মিকির সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণের
বাংলা ভাষায় ভাবানুবাদ করেন। গ্রন্থটির নাম “শ্রীরাম পাঁচালী”। তবে এটি
“রামায়ণ পাঁচালী” বা “কৃত্তিবাসী রামায়ণ” নামেও পরিচিত। পঞ্চদশ
শতাব্দীর প্রথমার্ধেই গ্রন্থটির অনুবাদকর্ম শুরু হয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণ সাতটি কান্ডে
বিভক্ত- আদিকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ড
ও উত্তরাকাণ্ড।
• কবি পরিচিতি: কৃত্তিবাসের “আত্মপরিচয়” থেকে জানা যায় কবির
পূর্বপুরুষ ছিলেন পূর্ববঙ্গের বেদানুজ রাজার সভাসদ নরসিংহ ওঝা। তিনি নদীয়াজেলার ফুলিয়া
গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পৌত্র মুরারি ওঝা কৃত্তিবাসের পিতামহ।কবির পিতার নাম
বনমালী ওঝা, মাতা মালিনী। মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে রবিবারে তিনি ফুলিয়া গ্রামে
জন্মগ্রহণ করেন।
• কৃতিত্ব বা জনপ্রিয়তা: পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায়
400 বছর ধরে অনুদিত হয়েছে।বহু কবি এই অনুবাদ কর্মে হাত লাগিয়েছেন।কিন্তু আদি কবি
কৃত্তিবাস ওঝাই শ্রেষ্ঠ কবি রূপে আজও বাঙালি হৃদয়ে সমাদৃত। ধনীর অট্টালিকা থেকে দরিদ্রের
পর্ণকুটির পর্যন্ত তার গ্রন্থটির জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন। তাঁর জনপ্রিয়তার অবশ্যই তাঁর
অসামান্য প্রতিভাকেই স্মরণ করায়।
আসলে কৃত্তিবাসের অনুবাদ আক্ষরিক অনুবাদ নয়, তা ভাবানুবাদ। তিনি গল্প
রসকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে তিনি কাহিনীকে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন।
কার্তিকের জন্ম, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি প্রসঙ্গ যেমন বর্জন করেছেন তেমনি সংযোজন
করেছেন গণেশের জন্ম, গুহক চন্ডাল, তরণীসেন প্রভৃতি প্রসঙ্গ। এভাবে কাহিনীকে তিনি বাঙালির
মনের মতো করে সাজিয়েছেন।
তাঁর সৃষ্ট রামায়ণের প্রত্যেকটি চরিত্র অত্যন্ত সজীব এবং হৃদয়গ্রাহী।
বাঙালির প্রাণের রসে সিক্ত করেই যেন তিনি চরিত্রগুলি এঁকেছেন। রামচন্দ্র যেন আমাদের
পরিবারেরই আদর্শ দাদা,সীতা আদর্শ বাঙালি গৃহবধূ, লক্ষ্মণ কর্তব্য পরায়ন ভাই- সব যেন
বাঙালি ঘরোয়া আদর্শে সৃষ্ট এবং সজীব।
রসসৃষ্টিতেও যেন কৃত্তিবাস সুনিপুণ। বাঙালির মজ্জার সঙ্গে মিশিয়ে তিনি
রামায়ণে করুণ রসের আধিক্য সৃষ্টি করেছেন। রামের বনবাস, সীতাহরণ, লক্ষ্মণের শক্তিশেল,
সীতার পাতাল প্রবেশ প্রভৃতি করুনরসসিক্ত কাহিনী বাঙালির হৃদয়কে বেদনার আপ্লুত করে।
তবে বীররস ও হাস্যরস সৃষ্টিতেও তার কৃতিত্ব কম নয়।
কৃত্তিবাসের রামায়ণে ফুটে উঠেছে বাঙালির পারিবারিক আদর্শ গুলি। রামচন্দ্রের
পিতৃভক্তি ও ভাতৃপ্রেম, সীতার পতিব্রতা ও স্নেহশীলতা, লক্ষ্মণের কর্তব্যপরায়ণতা, ভরতের
আনুগত্য -প্রভৃতি নৈতিক আদর্শকে টেনে এনেছেন সর্বসমক্ষে।
আপন প্রতিভার ছোঁয়ায় কৃত্তিবাস বাঙালির জীবন-জীবিকা, নিসর্গপ্রকৃতি,
পশুপাখি, আচার-প্রথা, বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস, রীতিনীতি ইত্যাদিকে চিত্রিত করেছেন তাঁর
রামায়ণে। সমকালীন অন্য কোনো কবির কাব্যে যা এমনভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি। এটাই কৃত্তিবাসের
বাঙালিয়ানা।
কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করেছিলেন। ভাগবতের মতো
তা কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাই জাতি -ধর্ম নির্বিশেষে তা জনমানসে
আদৃত হতে পেরেছিল।
করুণ রসের পাশাপাশি রামায়ণে যে ভক্তিরসের প্লাবন ঘটেছিল তা সহজেই বাঙালি
চিত্তকে জয় করে নিয়েছিল। ভক্তবৎসল রামকে নিয়ে এ কাব্য যেন ভক্তিরই লীলা।
সহজ-সরল সুললিত ভাষা ব্যবহারে কৃত্তিবাসের ভাষা নৈপুণ্যের পরিচয়বাহী।
সহজ কথা সহজ ভাষায় যে বলার দক্ষতা ছিল কবির। তাঁর ভাষা এতটাই হৃদয়গ্রাহী ছিল যে তাঁর
অনেক পদগুচ্ছ বাগধারায় পরিণত হয়ে বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে চলেছে। যেমন- রাবণের চিতা,
কালনেমির লঙ্কাভাগ, ঘরশত্রু বিভীষণ, রাম-রাজত্ব, লঙ্কাকাণ্ড প্রভৃতি।
পয়ার,ত্রিপদী ছন্দের স্বচ্ছন্দ ও সুললিত প্রয়োগ, অনুপ্রাস, রূপক, উৎপ্রেক্ষা
প্রভৃতি অলংকারের প্রয়োগ নৈপুণ্যে শ্রীরাম পাঁচালী অনন্য।
বাঙালির জাতীয় মহাকাব্য কৃত্তিবাসী রামায়ণের আয়নায় বাঙালি
আপন মুখ দেখে স্তম্ভিত, বিস্মিত, পুলকিত হয়েছে। তাই সে দর্পণ থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি-
আজও তার রেশ সমানভাবে চলেছে।
- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সমাজচিত্র বা সামাজিকতা বর্ণনা করো
- রামায়ণের শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে কৃত্তিবাস ওঝার কৃতিত্ব
- কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব
- মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে? তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করো
- চর্যাপদের বিষয়বস্তু কি?
- চর্যাপদের সমাজচিত্র বর্ণনা দাও
- চর্যাপদ এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আলোচনা করো
- চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য অথবা কাব্যমূল্য বিচার করো