শিক্ষায় বংশগতি ও পরিবেশের গুরুত্ব
(Importance of Heredity and Environment in Education) :
শিশুর শিক্ষায় বা তার জীবন বিকাশের মূলে
আছে বংশগতি ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। প্রসিদ্ধ মনোবিদ স্যান্ডিফোর্ড
(Sandiford)-এর পরীক্ষা থেকে দেখা যায় যে, দৈহিক কোনো ত্রুটি শিক্ষার মধ্যে হীনমন্যতার
জন্ম দেয়। ফলে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। যদিও দৈহিকভাবে উচ্চতা, আকৃতি, দৈহিক
গঠন ইত্যাদি শিশুর শিক্ষাকে ততটা প্রভাবিত করে না। দৈহিক বংশগতি ছাড়া শিশুর মানসিক
দিক থেকে উত্তরাধিকারী সূত্রে কতকগুলি শক্তি লাভ করে যেগুলি তার ভবিষ্যৎ শিক্ষার প্রকৃতি
ও কার্যকারিতাকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
সুতরাং, এইসব দিক থেকে বিচার করলে শিশুর
শিক্ষায় দৈহিক, মানসিক এবং মনঃপ্রকৃতিগত বংশধারার প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে
বংশধারার গুরুত্বকে বিচার করলেও শিক্ষক ও পরিবেশের গুরুত্বকে অস্বীকার করা তো যায়ই
না, বরং শিক্ষায় মূল অবয়বটি গড়ে ওঠে পরিবেশের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। বীজ যতই সম্ভাবনা
ও সদগুণ সম্পন্ন হোক্ না কেন, শুষ্ক পাথরের ওপর পড়ে থাকলে তার কোনোদিনই অঙ্কুরোদগম
হবে না। আবার একটি অল্প গুণসম্পন্ন বীজ পরিবেশের সুনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উপযুক্ত জল,
আলো, বাতাস দিয়ে পরিচর্যার ফলে সুন্দরভাবে বিকশিত হতে পারে। সেরূপ শিশুর শিক্ষা ও
ব্যক্তিসত্ত্বা (Personality) গঠনে পরিবেশের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে শিক্ষক বিরাট ভূমিকা
পালন করতে পারেন। শিক্ষার্থী যখন বিদ্যালয়ে আসে, সে যে জন্মগত ক্ষমতা নিয়ে আসে তার
ওপর শিক্ষকের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অর্থাৎ, শিশুর বংশগতির ওপর শিক্ষকের কোনো ভূমিকা
নেই, কিন্তু শিশু যে শিক্ষা পরিবেশে অর্থাৎ, বিদ্যালয়ে আসে সেই বিদ্যালয় পরিচালন,
শিক্ষা পরিবেশ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা শিক্ষকের থাকে। সুতরাং, বংশগতির সূত্রে
প্রাপ্ত সম্ভাবনাকে উপযুক্ত পরিবেশের মধ্যে স্থাপন করে বিকশিত করা যায়।
বংশগতি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে শিশুর কোনো ভূমিকা
নেই। অন্যদিকে শিক্ষক শিশুর জৈবিক বংশগতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ঠিকই, কিন্তু সামাজিক
পরিবেশ ও সামাজিক বংশগতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। শিক্ষকের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করলে
দেখা যায়, তিনি নানাভাবে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে শিশুর বিকাশে সহায়তা করতে পারেন।
সেগুলি হল—
(১) ব্যক্তিগত বৈষম্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে
শ্রেণিতে শিশুদের বিভাজন করে তাদের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে পাঠ-পরিকল্পনা
তৈরি করা ও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা।
(২) শিখন পদ্ধতিকে মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর
প্রতিষ্ঠিত করা।
(৩) শিক্ষার্থীর আগ্রহ, রুচি, সামর্থ্য অনুযায়ী
শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুর মধ্যে বৈচিত্র্য আনা।
(৪) শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা ও
অপসংগতিমূলক বা সমস্যামূলক আচরণগুলির সমাধান করা ও প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা
করা।
(৫) বিদ্যালয়ের পরিবেশকে স্বাস্থ্যপ্রদ করে
গড়ে তোলা।
(৬) শিক্ষার্থীর স্বাস্য সম্পর্কে সচেতনতা
গড়ে তোলা ও বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।
(৭) শিখন সহায়ক উপকরণ, প্রদীপন যথোপযুক্তভাবে
প্রয়োগ করে শিশুকে শিখন কার্যে আগ্রহী করে তোলা। বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার
(Library) যাতে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করে সেদিকে শিক্ষককে বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ
গ্রন্থাগারই শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত কৃষ্টিমূলক পরিবেশ দেয়।
(৮) পশ্চাৎপদ শিশুদের অসাফল্যের বিভিন্ন কারণ
নির্ণয় করে সেগুলি দূর করা ও নির্দেশনার মাধ্যমে
সাফল্যের পথে নিয়ে যাওয়া। শিক্ষার ক্ষেত্রেই
হোক বা বৃত্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রেই হোক শিক্ষার্থীর প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীকে
পরিচালিত করতে না পারেন, তাহলে পরবর্তী জীবনে তার হতাশা আসবে।
(৯) উপযুক্ত পরিচালনা ও নির্দেশনা’র
(Guidance) মাধ্যমে শিশুকে ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তা করা।
(১০) শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক সম্পর্ক
(Human relation) গড়ে তোলায় সাহায্য করা। শিক্ষক
যদি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আদর্শ সম্পর্ক গড়ে
তুলতে না পারেন, তাহলে কখনই উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে না।
(১১) বিদ্যালয়ে শিশুর অবসর সময় উপযুক্ত
ভাবে কাটানোর জন্য ব্যবস্থা করা। যেমন—বিদ্যালয়ে খেলাধূলার ব্যবস্থা, সাহিত্য চর্চার
ব্যবস্থা, সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করলে শিক্ষার্থীরা তার মধ্য দিয়ে যেমন অনেক অভিজ্ঞতা
অর্জন করে, তেমনি বিদ্যালয়ের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পায়।
উপসংহার : এই সকল কাজকর্মের মাধ্যমে শিক্ষক
বিদ্যালয় পরিবেশকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারবেন। শিক্ষাকে সার্থকভাবে গড়ে তুলতে
হলে প্রয়োজন ব্যক্তিজীবনের বিকাশ। আর ব্যক্তি জীবনের বিকাশের জন্য প্রয়োজন বংশগতি
ও পরিবেশের বিকাশের প্রারম্ভিক পরিচয়, সঙ্গে প্রয়োজন পরিবেশের গতিপ্রকৃতি নির্ণয়
করার দক্ষতা। বংশগতি ও পরিবেশের যুগপৎ ক্রিয়া ছাড়া ব্যক্তিজীবনের বিকাশ অসম্ভব।
- শিক্ষকের ভূমিকা (The Role of the Teacher)
- শিক্ষকের কাজ ও দায়িত্ব (Function and Responsibilities of a Teacher)
- ‘শিক্ষা’ বা Education’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করো
- প্রাচীন মতে শিক্ষা কী?
- আধুনিক মতে শিক্ষা কী ?
- আধুনিক যুগের শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করো
- শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর সুসংহত বিকাশ-উক্তিটি আলোচনা করো
- শিক্ষার উদ্দেশ্য সংগতিবিধান বা অভিযোজন—উক্তিটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো
- শিক্ষার ব্যপক অর্থ বলতে কী বোঝায় | ব্যপক অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো
- সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা ও ব্যাপক অর্থে শিক্ষার পার্থক্য লেখ
- শিখনের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
- শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলি আলোচনা করো
- শিক্ষার লক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তা | শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করো
- শিক্ষার লক্ষ্য পরিবর্তনশীল কেন?
- শিক্ষার সমাজতান্তিক লক্ষ্য বলতে কি বোঝ | সমাজতান্তিক লক্ষ্যের বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি বা লক্ষ্যগুলি লেখ