শিক্ষার্থীর উপর বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব |

শিক্ষার্থীর উপর বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব
:

শিক্ষার্থী যখন বিদ্যালয়ে আসে সে যেসব জন্মগত
ক্ষমতা নিয়ে আসে তার ওপর শিক্ষার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অর্থাৎ, শিশুর বংশগতির
ওপর শিক্ষকের কোনো ভূমিকা নেই, কিন্তু শিশু যেই বিদ্যালয় পরিবেশে আসে, তখনই বিদ্যালয়
পরিচালন, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে। সুতরাং, শিশুর
বংশগতির সূত্রে প্রাপ্ত সম্ভাবনাকে উপযুক্ত পরিবেশের মধ্যে স্থাপন করে বিকশিত করা যায়।
তাই মানব শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে দুটি উপাদান ক্রিয়াশীল, এদের একটি হল বংশগতি
(Heredity) এবং অন্যটি হল পরিবেশ (Environment)।

 


বংশগতি
(Heredity)
: বংশগতি বলতে সেই সকল বৈশিষ্ট্যগুলিকে বোঝায় যা শিশু তার জন্মের সময়
তার পিতামাতার কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে এবং অন্যান্য পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পরোক্ষভাবে
পেয়ে থাকে। বংশধারাকে আমরা তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি—দেহগত, মানসিক ও মনঃপ্রকৃতিগত।
দেহগত বংশধারা বলতে বোঝায় সেই সকল দৈহিক বৈশিষ্ট্যাবলীর সমন্বয় বা সমবায় (গায়ের
রং, আকৃতি ইত্যাদি) যা শিশু পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পায়। মানসিক বংশগতি বলতে বোঝায়
সেই সব বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা এবং মানসিক প্রবণতার সমবায় যা শিশুর জন্মমূহূর্তে পিতামাতা
বা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে লাভ করে। আর মনঃপ্রকৃতি বলতে বোঝায় মনের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য,
আমরা যাকে বলি মেজাজ ৷ দেখা যায় মনের মৌলিক কাঠামো, সংগঠন ও প্রকৃতির দিক থেকে মানুষে
মানুষে প্রচুর পার্থক্য। এই জন্মগত বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় মনঃপ্রকৃতিগত বংশগতি।

 

মনোবিদ ও জীববিজ্ঞানের যুক্তি : মনোবিদ
উডওয়ার্থ (WoodWorth) বলেছেন—জন্মের শুরুতে যে সমস্ত উপাদানগুলি পিতামাতা থেকে শিশু
লাভ করে তাদের সমষ্টিই হল বংশগতি। ম্যাকুইসের জীবনের প্রারম্ভে মানুষের মধ্যে যা কিছু
উপাদান বর্তমান থাকে তাই হল বংশগতি। আধুনিক জীব বিজ্ঞানীগণ বলেন, মানুষের জনন কোশে
একধরনের সূক্ষ্ম সুতোর মতো পদার্থ থাকে, যাদেরকে বলা হয় ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোমের
মধ্যে অসংখ্য দানার মতো পদার্থ সুবিন্যস্তভাবে মালার মতো গাঁথা থাকে। এদেরকে বলা হয়
জিন বা DNA। আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জিনগুলিকে পৃথক পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব
হয়েছে। শিশুর জৈবিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলি তার জন্মগত জিন সংগঠন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত
হয়। সুতরাং, চরম বংশগতিবাদীদের মতে, শিশুকে উন্নত জীবনের অধিকারী করে গড়ে তুলতে হলে
তার বংশগতির বৈশিষ্ট্যগুলির ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।


পরিবেশ (Environment) : পরিবেশ কথাটির
শব্দগত অর্থ হল ব্যক্তির চতুঃপার্শ্ব। বিশ্ব প্রকৃতির যে অংশ দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত
তাই পরিবেশ। এই ধারণায় পরিবেশ একটি নিষ্ক্রিয় সত্ত্বা। কিন্তু আধুনিক মনোবিজ্ঞানে
পরিবেশের এই সংজ্ঞা মেনে নেওয়া হয়নি। বর্তমানে পরিবেশের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আমরা মনোবিদ
‘ডগলাস’ ও ‘হল্যান্ড’-এর মতানুসারে বলতে পারি যে, পরিবেশ বলতে বোঝায় সেই শক্তি বা
শক্তির সমবায় যা ব্যক্তির ওপর কোনো না কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং ব্যক্তির
আচরণকে বদলাতে পারে। এই মতানুসারে পরিবেশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এখানে কোনো একটি বস্তু
কোনো এক ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে ; সুতরাং, সেটি তার পরিবেশের মধ্যে পড়ে। আবার
সেই একই বস্তু অন্য এক ব্যক্তিকে প্রভাবিত নাও করতে পারে ; সুতরাং, সেটি তার পরিবেশের
অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, একটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বের পরিবেশ
এবং অন্যটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরের পরিবেশ। গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনো আঘাত, ওষুধের প্রভাব,
মায়ের মানসিক অবস্থা ইত্যাদি শিশুকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। তেমনি ভূমিষ্ঠ হওয়ার
পর শিশু যেসব প্রাকৃতিক, মানসিক ও সামাজিক শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়, তার প্রভাব
মৃত্যু পর্যন্ত চলে। তাই একথা বলা যায়, কেবলমাত্র উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করে শিশুর বিকাশের
প্রক্রিয়াকে সুনিয়ন্ত্রিত করা যায়।

প্রখ্যাত আচরণবাদী মনোবিদ জে. বি. ওয়াটসন
বলেছেন, “আমাকে এক ডজন সুগঠিত, স্বাস্থ্যবান শিশু দাও এবং আমি আমার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে
এদের মধ্যে যে-কোনো একটিকে কোনো বিচার না করেই বেছে নেবো এবং আমি আগে থেকেই যা ঠিক
করে দেবো সেই অনুযায়ী তাকে যে-কোনো ধরনের বিশেষজ্ঞ তৈরি করব।” এই বক্তব্য অনুসারে
যে-কোনো শিশুকে উপযুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে পারলে ইচ্ছানুযায়ী তার জীবনে
পরিবর্তন আনা যায়। মনোবিদ ক্যাটেল, ঈস্টার ব্লুক, বারবারা বার্ক, ফ্রিম্যান প্রভৃতি
মনোবিদগণ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, শিশুর জীবন বিকাশে
বংশগতি নয়, পরিবেশের প্রভাবই সর্বাধিক।


 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top