ভাবসম্মিলন কাকে বলে? আলোচ্য পদে রাধার আনন্দের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় বর্ণনা কর…

ভাবসম্মিলন
১. ভাবসম্মিলন কাকে বলে? আলোচ্য পদে রাধার আনন্দের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় বর্ণনা কর।
শ্রীরাধার ভাবলোকে রাধাকৃষ্ণের মিলনি ভাব সম্মিলন। “কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্” এবং তাঁর মর্তভূমিতে আসার উদ্দেশ্য কংস বধ। তাই যথা সময়ে তিনি রাধাকে ছেড়ে মধুরাগমনের ফলে কৃষ্ণ ব্যতীত রাধার দিনগুলি বিরহদীর্ণ হয়ে ওঠে। তখন বাস্তব জগতে কৃষ্ণকে না পাওয়ার বেদনা থেকে মুক্তি পেতে কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর রাধা অন্তরলোকে এবং ভাবের জগত গড়ে তুলে সেখানেই কৃষ্ণের সঙ্গেই চির মিলনের অনুভূতি ও আনন্দ লাভ করে- এই ভাবের জগতে মিলন ও আনন্দই ভাব সম্মিলন। ভাব সম্মিলন তাই ক্ষণমুহূর্তের জন্য ভাববিহ্বল এক বিরহিনী নায়িকার অন্তর্লোকে প্রিয় মিলনের চিরন্তন আনন্দ আস্বাদন – বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন ভাবের উল্লাস।
∆ বিদ্যাপতি রচিত আলোচ্য “ভাব সম্মিলন” পদটিতে শ্রী রাধার ভাব বিহ্বল অন্তরে কৃষ্ণ- সঙ্গ-সুখ জনিত আনন্দের চিত্রটি অসাধারণ কাব্যিক ছন্দে অনুপম রূপে চিত্রিত হয়েছে। কবিতার শুরুতেই রাধার উক্তিতে শোনা যায় –
“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর
চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর”।
“মাথুর” পর্যায়ের দীর্ঘ অদর্শন আর বিরহ যন্ত্রণা ভোগ করার পর আপন অন্তর মন্দিরে কৃষ্ণের উপস্থিতিতে রাধার আনন্দানুভূতি তার হৃদয়ের দুকুল প্লাবিত করে
শতধারায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে – যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
আনন্দের বশবর্তী হয়ে রাধা সখীদের কাছে অকপট স্বীকারোক্তি করেছে যে, কৃষ্ণ বিরহের দিনগুলিতে সুধাকর বা চাঁদ স্নিগ্ধোজ্জ্বল জোৎস্না ধারায় মিলনের মধুর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাধার অন্তরে প্রিয় মিলনের আকাঙ্খা তীব্রতর করে যত দুঃখ দিয়েছিল, আজ প্রিয় মুখ দর্শনে ঠিক ততটাই সুখ পেল। কবির ভাষায়- “পিয়া মুখ দরশনেতত সুখ ভেল”।
কৃষ্ণকে কাছে পাওয়ার আনন্দে রাধার কাছে আঁচল ভরা মহানিধি বা মূল্যবান সম্পদও তুচ্ছ হয়ে গেছে। তাই কৃষ্ণকে সে আর দূরে যেতে দেবে না।
রাধা তার কাছে কৃষ্ণের গুরুত্বের কথা চারটি উপমার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছে –
” শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষীর বা।
বরিষার ছা্ত্র পিয়া দরিয়ার না”।- অর্থাৎ শীতকালের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা কিংবা অকূল সমুদ্রে পারাপারের নৌকার মতো কৃষ্ণই রাধার কাছে একমাত্র আশ্রয় ও অবলম্বন- এ বক্তব্যও প্রিয় মিলন জনিত অপরিসীম আনন্দের পূর্ণ পরিস্ফুটন।
আসলে মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর কবি বিদ্যাপতি বিরহের দুঃখ নয় মিলনের আনন্দ দিয়েই কাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন এবং পদটিতে রাধার অন্তরের আনন্দ- শতদল বিকশিত করে পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।
২. “সুজনক দুখ দিবস দুই- চারি”- এখানে সুজন কে ও তার দুঃখের কারণ কি? কিভাবে তার দুঃখের অবসান হয়েছিল?
চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের বৈষ্ণব পদাবলীর বিখ্যাত কবি বিদ্যাপতি রচিত “ভাব সম্মিলন” পদে সুজন বলতে শ্রী রাধাকে বোঝানো হয়েছে।
আমরা জানি “কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্” এবং তাঁর আগমনের হেতু কংসবধ। তাই যথা সময়ে রাধাকে ছেড়ে দুষ্কৃতকারী কংসকে বধ করতে কৃষ্ণ মথুরায় গিয়েছেন। ফলে কৃষ্ণ বিহনে রাধার অন্তর বিরহ কাতরতায় পূর্ণ হয়েছে। প্রিয় বিচ্ছেদের ব্যথায় আকুল হয়েছে সমগ্র বৃন্দাবন। সুধাকরের স্নিগ্ধোজ্জ্বল জোৎস্না তার প্রিয় মিলনের আকাঙ্ক্ষাকে তীব্রতর করে বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ প্রিয় বিচ্ছেদই শ্রীরাধার অন্তরের অন্তহীন দুঃখের একমাত্র কারণ।
∆ বাস্তব জগতের যা কিছু অপ্রাপ্তি, ভাবের জগতে তার পরিতৃপ্তি- এ এক অদ্ভুত মানসিক প্রক্রিয়া। রাধার ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ্য করি তার বাস্তব জগতের কৃষ্ণ বিচ্ছেদের অন্তহীন দুঃখ ভাবের জগতের প্রিয় মিলনের দ্বারা অবসান ঘটেছে। শুধু অবসান নয় প্রিয় বিচ্ছেদের অন্তহীন দুঃখ প্রিয় মিলনের অবর্ণনীয় আনন্দে পরিণত হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাধার বক্তব্য ফুটে ওঠে –
“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর”। তাছাড়া বাস্তব জগত প্রকৃতি সৃষ্ট সেখানে অপরের কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা থাকে না।কিন্তু ভাবের জগত যেহেতু স্বসৃষ্ট তাই রাধা তার অন্তরে যে ভাবের জগত গড়ে নিয়েছে, সে জগতের নিয়ন্তা শ্রী রাধা নিজেই। তাই তার ভাবের জগতে কৃষ্ণের নিত্য উপস্থিতি। সে কথাই রাধার উক্তিতে শোনা যায়-
“চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর”। সুতরাং রাধা আর কৃষ্ণকে দূর দেশে পাঠাবে না। এভাবেই কৃষ্ণ বিচ্ছেদ জনিত রাধার অন্তরের বিরহ-বেদনা প্রিয় মিলনের চিরন্তন আনন্দে উত্তরণের মাধ্যমে অবসান হয়েছে।