নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত নাটক “আগুন” থেকে সমস্ত SAQ প্রশ্ন উত্তর দেওয়া হল

আগুন- বিজন ভট্টাচার্য
1. “আগুন” নাটক অবলম্বনে সিভিক গার্ডের চরিত্র আলোচনা কর।
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের লেখা “আগুন” নাটকের অন্তর্গত পঞ্চম দৃশ্যে সিভিক গার্ড চরিত্রটির উপস্থিতি দেখা যায়। আলোচ্য নাট্যাংশের স্বল্প পরিসরে সিভিকগার্ড চরিত্রটির নানাবিধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।
১. দক্ষ ও সচেতন কর্মীঃ- সিভিক গার্ড একজন দক্ষ ও সচেতন কর্মী, তাই দোকানের সামনের সারিবদ্ধ লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে সিভিক গার্ড সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয় -“এই সব টিকিট আছে তো? নইলে কিন্তু চাল মিলবে না বলে দিচ্ছি” আবার— “খুচরো পয়সা রেখেছেন তো!…..ও টাকা ফাকার চেঞ্জ দেওয়া চলবে না”।
২. শৃঙ্খলা রক্ষকঃ– সিভিক গার্ড একজন সু-শৃঙ্খলা রক্ষক। কখনো কখনো তাই দ্বিতীয় পুরুষকে লাইন থেকে টেনে হিঁচড়ে বাড় করেছেন, আবার কখনো বা বিশৃঙ্খলার অপরাধে দুঃস্থ চেহারার একটি লোকের গালে চপেটাঘাত করেছেন।
৩. রুঢ় ব্যবহার :- চাল সংগ্রাহকদের সঙ্গে সিভিক গার্ডের সর্বদা রূঢ় ব্যবহার চোখে পড়ে, নিরন্নদের প্রতি তার রূঢ় উক্তি – “চালাকি পেয়েছ। লুটের মাল, না —- মামার বাড়ির আবদার আর কী?”
৪. ভীতী প্রদর্শক :- নাট্য দৃশ্যে সিভিক গার্ড একজন ভীতী প্রদর্শক হিসাবে কাজ করেছে। তাই চতুর্থ পুরুষের প্রতি সে বলেছে- “তোমায় আমি পুলিশে দেব, দাঁড়াও”।
৫. তর্কবাগীশঃ- সিভিক গার্ড অত্যন্ত তার্কিকও বটে। বিনীত ভদ্র ব্যবহার তো সে করেইনি বরং লাইনে দাঁড়ানো সমস্ত ক্ষুধার্তের সঙ্গে সে বিনা কারণে বার বার তর্ক করেছে।
৬. নীতি পরায়নঃ- সিভিক গার্ড ব্যক্তিগতভাবে নীতিপরায়ন ব্যক্তি। নিজের চোখে না দেখে সে কোনো কিছু বিশ্বাস করে না। দোষী, নির্দোষ সম্পর্কে সে কাউকে কৈফিয়ত দিতে চায় না, তাই তৃতীয় পুরুষের প্রতি বলে – “পরের জন্য দরবার করতে হবে না আপনাকে।”
৭. বদমেজাজী: – সিভিক গার্ড অত্যন্ত বদমেজাজী হওয়ায় কখনো লাইনে দাঁড়ানো কাউকে টেনে বের করে দেয়। আবার কখনো কাউকে মারতেও উদ্যত হয় – “মুখ সামলে কথা বলো বলছি”। তার এই কথার মধ্য দিয়ে তার বদমেজাজের পরিচয় মেলে।
৮. কটুভাষী:- সিভিক গার্ড মানুষকে কটু কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে না, “থাক, তোকে আর দালালী করতে হবে না। যা ভাগ ভাগ”। এই সমস্ত সংলাপে তার কটুভাষার পরিচয় পাওয়া যায়। এইভাবে আলোচ্য নাট্যাংশের পঞ্চমদৃশ্যে সিভিক গার্ড চরিত্রটি নানাবিধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
2. আগুন নাটক অবলম্বনে শ্রমিক চরিত্রের পরিয়ে দাও?
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল কারখানার শ্রমিক সতীশ। সতীশ চরিত্রটির নানাবিধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচ্য নাট্যাংশে ফুটে উঠেছে।
১. কর্তব্য পরায়নে অস্থিরতা: কারখানার শ্রমিক সতীশ তার কর্তব্য বোধ সম্বরে সম্পর্কে সচেতন এবং তাই কাক ভোরে উঠে ঘুমন্ত মেয়ে ফুলকিকে ডেকে বলে – “ফুলকি উঠলি! বাপরে ঘুম! যেমনি মা তার তেমনই বেটি”। তার এই সংলাপে মন্বন্তর পরবর্তী বাংলার শ্রমিক পরিবারের মানসিক অস্থিরতা ফুটে উঠেছে।
২. সহকর্মীর প্রতি সদয়ঃ- সতীশ তার সহকর্মী জুড়োনের প্রতি সদয় ও সদ্ভাব পূর্ণ। এই মন্বন্তরের দুঃসময়ে যখন সতীশ সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তখন জুড়োনের সংসার “নেই” বলে তার খাবার জোগাড়ের চিন্তা ও নেই, এমনকি সে হয়ত একটু বেশি পয়সা দিয়ে হোটেলেই খেয়ে নিতে পারে। এই ধরনের বাক্যালাপের ধরণ দেখে বোঝা যায় সতীশের সঙ্গে তাঁর সহকর্মী জুড়োনের সু-সম্পর্ক আছে এবং সে সহকর্মীর সঙ্গে দৈনন্দিন কষ্টের কথা ভাগ করে নেয়।
৩. খাদ্যানুসন্ধানী কিন্তু আত্মভোগীঃ – সারাদিন চালের লাইনে দাঁড়িয়েও সতীশের স্ত্রী, কন্যাকে খালি হাতে ফিরে আসতে হলে ক্ষুধার বশে সতীশ রাত্রিবেলায় একজনের কাছ থেকে কিছু চাল ধার করে আনে ও তার মধ্যে এক পোয়া চালের ভাত সে নিজেই খেয়ে ফেলে। আবার সকাল হতে না হতেই জুড়োনকে বলে- “সকাল বেলাই তো আবার পেটে আগুন লেগে গেছে”, অর্থাৎ একদিকে সে ক্ষুধার অন্নের জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠেছে আবার অন্যদিকে স্ত্রী-কন্যা কারুর কথা না ভেবে সেই অন্নের অধিকাংশ নিজেই উদরসাৎ করেছে।
৪. সিদ্ধান্তহীনতাঃ- মন্বন্তর কালীন সময়ে সতীশ আস্থার বিপাকে পড়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। তাই কথা প্রসঙ্গে সে জুড়োনকে বলেছে “কোম্পানীর ভরসা করবো না, দোকানের ভরসা করবো না……তো কাকে ভরসা করি বল”। অর্থাৎ সংকটের সময় সে জ্ঞানশূণ্য ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
৫. পরিবারের প্রতি উদাসীন ও স্বার্থপরঃ- অভাবের সংসারে সতীশ তার স্ত্রী-কন্যার বাড়তি দায়িত্ব নেওয়া তো দূরে থাক বরং ধার করে আনা চালের ভাগ অধিকাংশ নিজেই উদরসাৎ করেছে। তার এই দায়িত্ববোধহীনতার কথা স্ত্রী ক্ষীরীর সংলাপে ফুটে উঠেছে – “পরনে নেই কাপড়, পেটে নেই ভাত, বড়ো সুখেই রেখেছ”। স্ত্রীকে সান্ত্বনা না দিয়ে সতীশ তাকে কটূক্তি করেছে, শাসিয়েছে, এমনকি পদাঘাত করার মতো দুর্ব্যবহারও করেছে।
এইভাবে সতীশ চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে নিরন্ন শ্রমিক শ্রেণীর হতাশা ও অসহায়তার কথা ফুটে উঠেছ।
3. “থাক, আর অফিসের কথা তুলো না বাপু একেবারে ঘেন্না ধরিয়ে দিলে”- কোন অফিসের কথা বলা হয়েছে? বক্তা কে?
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের লেখা “আগুন” নাটক থেকে জানতে পারি মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা, অফিসকর্মী হরেকৃষ্ণ বাবু যে অফিসে কাজ করেন সেই অফিসের কথা বলা হয়েছে।
∆ উদ্ধৃতাংশটির বক্তা হলেন হরেকৃষ্ণ বাবু।
4. “বাবুদের নামে সস্তা দরের চাল ডাল এনে কর্তারা আবার সেগুলো চরা দরে বাজারে ছাড়ছেন “- কোন প্রসঙ্গে বক্তা এমন উক্তি করেছেন?
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের লেখা ‘আগুন’ নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা অফিসকর্মী হরেকৃষ্ণ বাবুর স্ত্রী মনোরমা দেবী যখন হরেকৃষ্ণ বাবুকে প্রশ্ন করেন যে হরেকৃষ্ণ বাবু বলেছেন দুর্ভিক্ষের সময় অফিস থেকে বাবুদের চাল-ডাল দেওয়ার ব্যবস্থা হবে, তার কী হল তখন সেই প্রসঙ্গে হরেকৃষ্ণবাবু প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।
5. ” চা নেই, চিনি নেই, চাল নেই খালি আছে চুলোটা তাও আবার কয়লার অভাব”- মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণীর যে জীবন যন্ত্রণার চিত্র আলোচ্য নাটকে ফুটে উঠেছে তা লেখ?
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেঃ- নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের লেখা ‘আগুন’ নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে মধ্যবিত্ত অফিসকর্মী হরে কৃষ্ণ বাবু ও তার স্ত্রী মনোরমা দেবীর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের অসচ্ছলতার ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
চতুর্থ দৃশ্যের শুরুতে মন্বন্তরকালীন মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক অনটনের ছবিটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে মনোরমা দেবীর সংলাপে, – “চা নেই, চিনি নেই, চাল নেই, খালি আছে চুলোটা,তাও আবার কয়লার অভাব”।সরকার থেকে দুসের করে চাল দেওয়ার কথা স্ত্রী মনোরমা দেবীর কাছে থেকে শুনে হরে কৃষ্ণ বাবু জানান যে তাকে বেলা দশটার মধ্যে অফিসে ঢুকতে হবে। এই দিকে লাইনে দাঁড়িয়ে বারোটার আগে চাল পাওয়ার আশা নেই ।
আবার চাল যে নিশ্চিত ভাবে পাওয়া যাবে তারও কোনো স্থিরতা নেই। কারণ শেষে দোকানি হয়তো জানাবে চাল নেই। মনোরমাদেবী হরে কৃষ্ণ বাবুকে – যখন প্রশ্ন করে যে অফিস থেকে সে সব খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার কথা ছিল তার কী হল তখন হরে কৃষ্ণ বাবু তার অফিসের ম্যানেজার ও তার মোসাহেবদের এক দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেন। অফিসের উচ্চ পদস্থ কর্তারা বাবুদের নামে সস্তাদরে চাল ডাল এনে সেগুলি আবার চড়া দামে বাজারে ছেড়ে ব্যবসা করছেন। আসল সুবিধা ভোগ করছে ম্যানেজার ও তার মোসাহেবরা, অথচ সাধারণ মানুষ জানছে সমস্ত অফিসকর্মীরা সস্তাদরে চাল ডাল পাচ্ছে।
∆ শ্রমিক পরিবারের দৃশ্য:- আলোচ্য নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে দুর্ভিক্ষ ও কালোবাজারি জনিত কারণে এক শ্রমিক পরিবারকে কীভাকে অর্থনৈতিক অভাব গ্রাস করেছে এবং তার ফলে পারিবারিক সম্পর্ক কীভাবে অশান্তির আগুনে পুড়ছে, তা ফুটে উঠেছে।
সতীশ, তার স্ত্রী ক্ষীরী ও মেয়ে ফুলকিকে নিয়ে তিনজনের সংসার। মুনাফালোভী মহাজন ও অসাধু কালোবাজারি ব্যাবসায়ীরা যেভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সৃষ্টি করেছিল, তার ফলে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ গুলোর পক্ষে দুবেলা গ্রাসাচ্ছাদন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পরে, পরিবারের কর্তা হয়ে সতীশ ও অন্ন সংস্থান করতে ব্যর্থ হয়। চালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে শেষপর্যন্ত সতীশের স্ত্রী ক্ষীরীকে খালি হাতে ফিরতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু ক্ষিদের জ্বালায় এই বাস্তবতাটা সতীশ মানতে পারেনি। তাই আগের দিনের ধার করে আনা চালে অধিকাংশ ভাতই নিজে খেয়ে পরেরদিন সকাল বেলা কারখানা যাওয়ার আগে আবার ভাত চায়। এতে সতীশের স্ত্রী রেগে গিয়ে সতীশকে কথা শোনালে পৌরুষত্বে আঘাত লাগে এবং সতীশ ক্ষিরিকে এর জন্য সাজা দেওয়ার কথা বলে। ক্ষিরীও সতীশের অপদার্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।