রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দাও | রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো | Political Science 2nd Chapter Note Pdf | ClassGhar |


রাষ্ট্রের সংজ্ঞা :

রাষ্ট্র
হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু
ও শেষ। কিন্তু রাষ্ট্রের সঠিক সংজ্ঞা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি।
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন।

1. সাবেকি সংজ্ঞা : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র হল
স্বাবলম্বী ও পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি।
প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রের পটভূমিকায় অ্যারিস্টটলের দেওয়া এই সংজ্ঞা বর্তমান যুগের
আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষে প্রযােজ্য নয়। এ যুগে স্বাবলম্বী’ ও ‘পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রের
অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

2. আইনগত সংজ্ঞা: প্রখ্যাত আইনবিদ হলের মতে, রাষ্ট্র হল এমন এক জনসমাজ
যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বহিঃশক্তির
নিয়ন্ত্রণ থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত। ওপেনহাইমের অভিমত হল, যখন কোনো নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডে
কোনো সংগঠিত জনসমষ্টি সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠা করে তখন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। আবার,
প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসনের মতে, কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইন প্রতিষ্ঠার জন্য
সংগঠিত জনসমষ্টি হল রাষ্ট্র।

3. আদর্শবাদী সংজ্ঞা: কান্ট ও হেগেল উভয়েই রাষ্ট্রকে এক সর্বাত্মক ও ঐশ্বরিক
কর্তৃত্বসম্পন্ন অতিমানবীয় নৈতিক প্রতিষ্ঠানরূপে অভিহিত করেছেন। হেগেলের রচনায় রাষ্ট্রকে
পৃথিবীতে ঈশ্বরের পদচারণা বলে বর্ণনা করা হয়ে

4. আধুনিক সংজ্ঞা: আধুনিক আচরণবাদী চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রের প্রচলিত সংজ্ঞাগুলি
মেনে নিতে চাননি। এমনকি তাঁরা রাষ্ট্র’ শব্দটির পরিবর্তে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিভাষাটি
প্রয়ােগের পক্ষপাতী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস ও বুন্টলির মতে, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টি
হল রাষ্ট্র।

5. মার্কসবাদী সংজ্ঞা: মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে
বলেছেন রাষ্ট্র হল শ্রেণিশোষণের এক হাতিয়ার; এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণির ওপর প্রভুত্ব
বজায় রাখার প্রতিষ্ঠান। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণিস্বার্থ সংরক্ষণের একটি রাজনৈতিক
হাতিয়ার হল রাষ্ট্র।

6. গার্নারের সংজ্ঞা: গার্নারের মতে, রাষ্ট্র হল সাধারণভাবে বৃহৎ এক জনসমাজ
যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ
বা প্রায় মুক্ত এবং যার একটি সুসংগঠিত সরকার রয়েছে। ও সেই সরকারের প্রতি অধিকাংশ
জনগণ স্বাভাবিক আনুগত্য প্রদর্শন করে।

রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য/রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান:

রাষ্ট্র
সম্পর্কে গার্নারের দেওয়া সংজ্ঞা থেকেই রাষ্ট্রের চারটি অপরিহার্য উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের
সন্ধান পাওয়া যায়।

সেগুলি
হল—[i] জনসমষ্টি, [2] নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, [3] সরকার ও [4] সার্বভৌমত্ব।

1. জনসমষ্টি: রাষ্ট্রের মৌল উপাদান হল জনসমষ্টি। জনগণের কল্যাণের
জন্যই রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই জনগণকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কথা ভাবা যায় না। আধুনিক
রাষ্ট্রে জনসমষ্টিকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়—

i.
নাগরিক, ii. বিদেশি ও iii. প্রজা। যাঁরা রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের
প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং আইনসম্মতভাবে রাষ্ট্রপ্রদত্ত যাবতীয় সুযোগসুবিধা
এবং অধিকার ভোগ করে থাকেন তাদের নাগরিক বলা হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রের মধ্যে যেসব ভিনদেশি
নাগরিক সাময়িকভাবে বসবাস করেন তাদের বিদেশি আখ্যা দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিদেশি শাসনের
অধীনে বসবাসকারী জনগণকে বলা হয় প্রজা। যেমন, ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টের আগে ভারতবাসীরা ছিল
ব্রিটিশদের প্রজা। একটি রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ঠিক কত হওয়া উচিত তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা
একমত নন। বর্তমানে একদিকে যেমন পানামা (৩৩ লক্ষ), মােনাকো (৩২ হাজার), সান ম্যারিনো
(৩০ হাজার), ভ্যাটিকান সিটি (৯০০)র মতো ক্ষুদ্র জনসমষ্টির রাষ্ট্র রয়েছে, তেমনি চিন
(১২৯ কোটি ৪৯ লক্ষ), ভারত (১০২ কোটি, ২০০১ সাল) প্রভৃতি বৃহৎ জনবহুল রাষ্ট্রও দেখা
যায়।

2. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড: নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হল রাষ্ট্রের দ্বিতীয় অপরিহার্য
উপাদান। জনসমষ্টির বসবাসের জন্য একটি ভৌগোলিক সীমানাবিশিষ্ট নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকা
প্রয়োজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, কোনাে জনসমষ্টি যতক্ষণ না কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের
অধিকারী হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে না। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বলতে
রাষ্ট্রের অধীনস্থ থলভাগ, জলভাগ ও বায়ুমণ্ডলকে বোঝায়। কাজেই রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট
ভূখণ্ডের সীমানার মধ্যে নদনদী, পাহাড়-পর্বত, অরণ্য, আকাশসীমা, সমুদ্র, উপকূল ইত্যাদি
সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের আয়তন কেমন হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। ফরাসি দার্শনিক রুশো ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্রের
পক্ষপাতী ছিলেন। আবার জার্মান দার্শনিক ট্রিটকে মনে করতেন, রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রত্ব হল
পাপের প্রতীক। তবে আয়তন যাই হােক না কেন, নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ড ছাড়া রাষ্ট্র গঠন
অসম্ভব।

3. সরকার: রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে একটি তাত্ত্বিক ধারণা। বিমূর্ত
রাষ্ট্রের বাস্তব রূপ হল সরকার। কার্যক্ষেত্রে রাষ্ট্র বলতে আমরা সরকারকেই বুঝি। অধ্যাপক
গার্নারের মতে, রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বা যন্ত্র হল সরকার। উইলোবির মতে, সরকার হল এমন
এক প্রতিষ্ঠান বা যন্ত্র যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে কার্যকরী করে।

         রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপালনকারীদেরই
সাধারণভাবে সরকার বলা হয়। সরকারের বিভিন্ন রূপ আছে, যেমন—গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক,
একনায়কতান্ত্রিক, এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয়, রাষ্ট্রপতি শাসিত ও মন্ত্রিপরিষদ-চালিত
ইত্যাদি। তবে সরকারের রূপ যাই হোক না কেন, রাষ্ট্রের নীতি ও আদর্শকে বাস্তবায়িত করাই
সরকারের প্রধান কাজ। সুতরাং, সরকারকে রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক বলা যেতে পারে।

4. সার্বভৌমত্ব: অধ্যাপক গেটেলের মতে, সার্বভৌমত্ব হল আধুনিক রাষ্ট্রের
ভিত্তি। অনেকে মনে করে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌমত্ব না থাকে তবে তাকে কোনো মতেই
রাষ্ট্র আখ্যা দেওয়া যায় না।

         সার্বভৌমত্ব দু-ধরনের-(i) অভ্যন্তরীণ এবং
(ii) বাহ্যিক। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব বলতে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতাকে
বােঝায় অর্থাৎ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকার নিজেও রাষ্ট্রীয়
আইনের। উর্ধ্বে নয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব বলতে বোঝায় যে, বহিঃশক্তির
সমস্ত রকম নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্র মুহ অর্থাৎ এই সার্বভৌমত্বের শক্তিতে কোনাে স্বাধীন
রাষ্ট্র বিদেশি রাষ্ট্রের নির্দেশে পরিচালিত হয় না। বর্তমানে অবশ্য রাষ্ট্রের সার্বভৌম
ক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক—কোনো দিক থেকেই চরম ও অবাধ নয়। আধুনিক বিশ্বে আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ও অন্যান্য নানান আঞ্চলিক সংগঠনের
সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রকে যেসব নিয়মকানুন। মেনে চলতে হয় তার ফলে রাষ্ট্রের চরম ও অবাধ
সার্বভৌম ক্ষমতা বাহ্যিক দিক থেকে শিথিল হয়ে পড়েছে বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রের
অভ্যন্তরে যেভাবে বিভিন্ন সংগঠন ও পুরসমাজের ভূমিকা নাগরিক জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে
তার ফলে রাষ্ট্রের অবাধ সার্বভৌম ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ক্ষুন্ন হয়ে পড়েছে বলে
মনে করা হয়।

অন্যান্য বৈশিষ্ট্য: উপরিউক্ত চারটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ছাড়াও রাষ্ট্রের
আরও তিনটি অপ্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

সেগুলি
হল—[1] স্থায়িত্ব, [2] আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও [3] জাতীয়তাবাদ।

1. স্থায়িত্ব: যে রাষ্ট্রের কোনো স্থায়িত্ব নেই তাকে রাষ্ট্র বলা
যায় না। সরকারের অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী, আজ যে সরকার ক্ষমতায় আছে কাল তা নাও থাকতে
পারে। কিন্তু রাষ্ট্র চিরস্থায়ী, তার একটি সুষ্ঠু ধারাবাহিকতা আছে। অবশ্য মার্কসবাদীরা
রাষ্ট্রকে চিরস্থায়ী বলে মেনে নিতে চাননি।

2. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: রাষ্ট্রের আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না পেলে কোনো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রকৃত
অর্থে রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় না।

3. জাতীয়তাবাদ: কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য
হিসেবে জাতীয়তাবাদের কথা বলে থাকেন। তাঁদের মতে, জাতীয়তাবাদের আদর্শে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ
না হলে কোনো জনসমষ্টি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে সফল হতে পারে না। অবশ্য রাষ্ট্রভেদে
জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের ধারা স্বতন্ত্র হতে বাধ্য।


Download Pdf

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top