রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করো।
অথবা, মার্কসীয়
দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতির প্রকৃতি আলোচনা করো।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান
পাঠের মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি:
সমগ্র মানবসমাজের বিকাশের ধারাকে মার্কসবাদ
মৌলিক ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির মূল দিকগুলি
হল-
(1) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদঃ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে জগৎ প্রকৃতিগতভাবে বস্তুময়।
জগতের প্রতিটি বস্তু পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই বস্তুজগৎ
সতত পরিবর্তনশীল। বস্তুজগতের এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে বস্তুর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব বা
বিরোধ। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের এই সূত্রকে মানবসমাজের ইতিহাস পর্যালোচনায় মার্কস
প্রয়োগ করেছেন। এইভাবে দাসসমাজ, সামন্তসমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজে সম্পত্তিবান মালিক শ্রেণির
সঙ্গে সম্পত্তিহীন সর্বহারা শ্রেণির দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে তিনি ব্যাখ্যা করেন।
(2) ঐতিহাসিক বস্তুবাদঃ সমাজবিকাশের ধারা-সম্পর্কিত মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের একটি বিশেষ দিক। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের
সাহায্যে সমাজ পরিবর্তনের ধারাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
মানবসমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস সার্থকভাবে পর্যালোচনা করেছে। মার্কস সমগ্র
মানব-ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, উৎপাদন এবং উৎপাদন-পদ্ধতি মানবসমাজের মৌলিক
পরিবর্তন ঘটিয়েছে। উৎপাদন ব্যবস্থা হল সমাজের অর্থনৈতিক বনিয়াদ। এর ওপর ভিত্তি করেই
সমাজের উপরিকাঠামো (Super structure) নির্মিত হয়েছে।
(3) উৎপাদন-ব্যবস্থার দুটি দিক: ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য
বিষয় হল, সমগ্র মানবসমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার ইতিহাস বিশ্লেষণ। উৎপাদন ব্যবস্থার দুটি
দিক রয়েছে। একটি হল উৎপাদন শক্তি, অন্যটি হল উৎপাদনসম্পর্ক। উৎপাদন শক্তি বলতে বোঝায়
শ্রমিক ও তার শ্রম ক্ষমতা এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি। অন্যদিকে উৎপাদন-সম্পর্ক হল উৎপাদন
প্রক্রিয়ায় যুক্ত মানুষ বা শ্রেণির উৎপাদনভিত্তিক পারস্পরিক সম্পর্ক। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি
অনুসারে সমাজ বিবর্তনের একটা পর্যায়ে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের
বিরোধ ঘটলে সামাজিক বিপ্লবের সূচনা হয়। এর ফলে সমাজের উপরিকাঠামো অর্থাৎ প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা,
আইন, আদর্শঃসামগ্রিকভাবে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এইভাবে উৎপাদন-পদ্ধতির পরিবর্তনের
পরিপ্রেক্ষিতে আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাসসমাজ, সামন্তসমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজের উদ্ভব
ও বিবর্তন ঘটেছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী দাসসমাজ, সামন্তসমাজ ও পুঁজিবাদী
সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিত্তবান শ্রেণির স্বার্থে গড়ে ওঠে।
উপসংহারঃ- পরিশেষে বলা যায়, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতির
আলোচনাকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে দেখা হয়নি। মার্কস উৎপাদন ব্যবস্থাকে মূল কাঠামো হিসেবে
চিহ্নিত করে রাজনীতিকে উপরিকাঠামাের একটি অংশরূপে ব্যাখ্যা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য
যে, নয়া-মার্কসবাদী (Neo-Marxists) চিন্তাবিদরা উপরিকাঠামোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে
পারেননি। নয়া-মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশি অভিমত প্রকাশ করেন যে, সমাজের
উপরিকাঠামােকে দুর্বল ভাবলে ভুল হবে। সমাজের উপরিকাঠামাের অঙ্গরূপে রাজনৈতিক কাঠামোর
স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ প্রয়োজন।