“কে বাঁচায়,
কে বাঁচে “গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো ।
নামকরণ শুধু পরিচয়
জ্ঞাপক শব্দ রাজি নয়, তা সমগ্র সাহিত্যকর্ম টির অন্তর্নিহিত অভিব্যক্তির সুষম বাণীর
প্রকাশ। নামকরণ কখনো হয় বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক, কখনোবা চরিত্র নির্ভর, আবার কখনো তা
ব্যঞ্জনা ধর্মী। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “কে বাঁচায়, কে বাঁচে”গল্পের
নামকরণ বিষয়বস্তু বা চরিত্র নির্ভর নয় – তা সুগভীর ব্যঞ্জনার বাণীরূপ ।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের
পটভূমিকায় রচিত এই গল্পটির কাহিনী পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাই যে, ফুটপাতে এক অনাহারে
মৃত্যুর ঘটনা দর্শনকে কেন্দ্র করে গল্পের কেন্দ্রীয়
চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়ের ক্রমবিবর্তন ও পরিণতিই গল্পটির মূল ঘটনা । শহুরে মৃত্যুঞ্জয এক
অফিস-চাকুরে। অফিস আর সংসারের মধ্যেই সীমিত ছিল তার জগত। অনাহারক্লিষ্ট ফুটপাতবাসীরা
ছিল তার চোখের অন্তরালে। একদিন অফিস যাবার পথে সে প্রত্যক্ষ করে ফুটপাতের অনাহারে মৃত্যুর
ঘটনা। এই সত্য তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে । আদর্শ আর নীতিবোধ তাকে
পিডীত করে। রোজ চারবার সে পেটপুরে খায়,অবকাশ
যাপন করে। অথচ দুর্ভিক্ষ ক্লিষ্ট বুভুক্ষু মানুষের অন্নসংস্থানে অংশ নেয়নি -এ কারণে
সে নিজেকে অপরাধী মনে করে। এরপর সে নিজের খাওয়া কমিয়ে দেয় । মাইনের পুরো টাকাটা
রিলিফ ফান্ডে দান করে। অফিস ও সংসারের প্রতি অমনোযোগী হয়ে ওঠে। অবসাদগ্রস্ত হয়ে এসে
ফুটপাতের লঙ্গরখানায় ঘোরে ।অভিযোগহীন বুভুক্ষু মানুষের কথা শোনে। বন্ধু ও সহকর্মী নিখিল তাকে যুক্তি দিয়ে
বোঝাতে চাইলে ও তার অভিজ্ঞতার কাছে সব যুক্তি অর্থহীন হয়ে যায়। একখণ্ড ছিন্ন বস্ত্রে
একটি মগ হাতে নিয়ে একসময় সেও মিশে যায় দুর্ভিক্ষ পীড়িত অন্ন ভিক্ষুদের দলে। মৃত্যুপিডীত
মানুষের সাহায্য করতে গিয়ে সে নিজেই পৌঁছা যায় মৃত্যুর মুখে ।
গল্পটি চরিত্র কেন্দ্রিক
হলেও নামকরণের সেই চরিত্র নাম নেই, নেই কোনো বিশেষ ঘটনার প্রতিফলন। নামকরণে লেখক জীবন-অস্তিত্বের
মূল ধরে টান দেওয়ার ভাষা ব্যবহার করেছেন। গল্পে আমরা শুনি পীড়িত মানুষের মুখে কোন
নালিশ নেই, প্রতিবাদে নেই, সবকিছু ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক লেখক
সাধারণ মানুষের মত ভাগ্য বিশ্বাসী ছিলেন না, তাই শোষিত মানুষের বাঁচার প্রশ্নে, ভাগ্যের
স্বীকৃতির ইঙ্গিত নেই নামকরণে। আসলেই দুর্ভিক্ষ যেখানে অনেকাংশেই স্বার্থপর, শোষক মানুষের
সৃষ্টি সেখানে। ভাগ্যের দোহাই নয়- বাঁচার জন্য চাই নালিশ, চাই প্রতিবাদ- বোধহয় এই
ইঙ্গিত এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে “কে বাঁচায়, কে বাঁচে” নামকরণের সুগভীর ব্যঞ্জনা। মনুষ্য
সৃষ্ট দূর্ভিক্ষ প্রতিকারের পথ রিলিফের মধ্যে নয়, লঙ্গরখানায় অনভিক্ষদের দলে মিশে
গেলেও তার সমাধান হয়না । প্রয়োজন কারণ অনুসন্ধান আর আত্মবিশ্বাসী প্রতিবাদী কন্ঠকে
জোরদার করা। কেউ কাউকে বাঁচায় না, নিজেদের সমবেত শক্তিতেই বাঁচতে হয়- এই অনুভবটি নামকরণ
কে ব্যঞ্জনাগর্ভী ও শিল্প সুষমামন্ডিত করে তোলে, পৌঁছে দেয় শিল্প সার্থকতা ।