শিক্ষার সমাজতান্তিক লক্ষ্য |
শিক্ষার সমাজতান্তিক লক্ষ্য বলতে কি বোঝ?
সমাজতান্তিক লক্ষ্যের বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি বা সমাজতান্তিক শিক্ষার লক্ষ্যগুলি লেখ। অথবা শিক্ষার লক্ষ্য হল “সামাজিক বিকাশ” আলোচনা
করো।
শিক্ষার যে সকল লক্ষ্য সমাজকে কেন্দ্র ক্রে স্থির ক্রা হয়, সেগুলিকে শিক্ষার
সমাজতান্তিক লক্ষ্য বলে। শিশু সমাজে জন্মগ্রহণ করে। সমাজের কোলেই সে লালিতপালিত হয়।
সমাজের মধ্যেই শিশু কালক্রমে ব্যক্তিতে পরিণত হয়। সমাজের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করে,
সমাজের সমৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে সে একজন সুস্থ নাগরিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
একেই আমরা সামাজিক বিকাশ বলি। শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক বিকাশ ঘটিয়ে
নিম্নলিখিত কর্মসূচিগুলি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে সাহায্য করা।
(1) সামাজিক প্রক্রিয়া আত্মীকরণ : সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, বোঝাপড়া
প্রভৃতি সামাজিক প্রক্রিয়াগুলি ব্যক্তি আয়ত্ত করে সমাজে বাস করতে গিয়ে। বিদ্যালয়
হল সমাজেরই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ও অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের
ফলে শিক্ষার্থীরাও সামাজিক প্রক্রিয়াগুলি আয়ত্ত করে।
(2) সামাজিক চেতনা বৃদ্ধি : বিদ্যালয়ে আসার পর শিশু বিভিন্ন সামাজিক পটভূমি
থেকে আসা সমবয়সিদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়, পরস্পরের টিফিন ভাগ করে খেতে শেখে।
একজন যদি পেনসিল, রবার, স্কেল আনতে ভুলে যায় তাহলে অন্য একজন তাকে সাহায্য করে। এইভাবে
সামাজিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।
(3) সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার : সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় সমাজের
প্রতি অনুভূতিশীল হওয়া, সমাজের মঙ্গল কামনা করা, সামাজিক উন্নতিতে অংশগ্রহণ করা, সামাজিক
ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করা, সামাজিক বিভেদ দূর করা, সামাজিক ন্যায়ের প্রতি আস্থা রাখা ইত্যাদি।
এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিকে একদিকে যেমন সামাজিক কাজে দক্ষ করে তোলে, অন্যদিকে জাতীয়তাবোধ
এবং আন্তর্জাতিকতাবোধের বিকাশে সাহায্য করে।
(4) সামাজিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধান : প্রতিটি সমাজেই বিভিন্ন রকমের অভ্যন্তরীণ
ও বাহ্যিক কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সামাজিক সমস্যার প্রতিরােধ ও সমাধানে শিশুকে দক্ষ
করে তােলাই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। শিক্ষার্থীকে একদিকে যেমন সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে
সচেতন করা প্রয়ােজন, অন্যদিকে সমস্যাসমাধানে কী করণীয়, সে বিষয়েও তাকে অবহিত করা
দরকার।
(5) সামাজিক দায়িত্বপালন : শিক্ষা সামাজিক বিকাশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে সামাজিক
দায়িত্বপালনে সক্ষম করে তোলে। এই দায়িত্বপালন করার জন্য যা যা প্রয়োজন, সেই বিষয়ে
প্রশিক্ষণও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই সে লাভ করে। যেমন, পরিবারের
আর্থিক উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করা সব শিক্ষার্থীরই দায়িত্ব।
(6)
সামাজিকীকরণ: সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে শিক্ষার্থী সামাজিক
আদবকায়দা, রীতিনীতি, নিয়মশৃঙ্খলা, দায়দায়িত্ব, ঐতিহ্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন
করে এবং ব্যক্তিজীবনের আচার-আচরণে তা প্রতিফলিত হয়। একেই সামাজিকীকরণ বলে। তাই সামাজিকীকরণ
শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
(7) সামাজিক মূল্যবোধ গঠন : সামাজিক মূল্যবোধ গঠন সামাজিক বিকাশের একটি বিশেষ
দিক। প্রতিটি সমাজেরই কিছু মূল্যবোধ থাকে। সমাজের স্থায়িত্ব ও গভীরতা অনেকাংশে তার
মূল্যবোধের ওপরই নির্ভর করে।
(৪) সামাজিক প্রগতিতে অংশগ্রহণ : শুধুমাত্র সামাজিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করাই
সামাজিক সদস্য হিসেবে শিক্ষার্থীর পক্ষে যথেষ্ট নয়। সমাজের প্রগতিতে তার ভূমিকা থাকাটাও
প্রত্যাশিত।
(9)
সমাজ সংরক্ষণ : সমাজের রীতিনীতি, প্রথা এবং সামাজিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা সমাজের
সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিক্ষার্থীদের এই দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন
করা শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। শিক্ষার্থীদের সামাজিক বিকাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষা এই লক্ষ্যটি
পূরণে সচেষ্ট হয়।
(10) সামাজিক সঞ্চালন: সমাজের রীতিনীতি, প্রথা এবং সামাজিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের
পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ওইগুলি তুলে দেওয়া সামাজিক সদস্য হিসেবে প্রতিটি
নাগরিকের কর্তব্য। শিক্ষার্থীদের সামাজিক বিকাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষা এই লক্ষ্যটির বাস্তবায়নে
সচেষ্ট হয়।
উপরিউক্ত আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, ব্যক্তির
বিকাশের পাশাপাশি সমাজের বিকাশও শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। প্রকৃতপক্ষে সমাজ তার স্বার্থ ও অস্তিত্ব
রক্ষার জন্য শিক্ষা কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছে। এই কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়েই প্রতিটি শিক্ষার্থী জানবে
কীভাবে সে সমাজের স্বার্থ এবং সামাজিক প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে।