চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য অথবা কাব্যমূল্য
• ভূমিকা: “প্রতীক রূপকের সাহায্যে চিত্র সৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত, মানব
চরিত্রের মধ্যে সুখ-দুঃখের বিরহ মিলনের দৈনন্দিন জীবন চিত্র চর্যার দর্শন ও তত্ত্বের
নিষ্প্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সজীব করিয়াছে”- অ .কু. ব
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকার ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর এই
মন্তব্যকে পাথেয় করে চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য বিচারে অগ্রসর হওয়া যাক। আমরা জানি যে,
চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন সংগীত। ধর্মাচরণের গুহ্য সংকেত, নির্বাণতত্ত্ব ও দর্শনই
চর্যার আলোচ্য বিষয় হলেও উক্ত বিষয়কে প্রকাশ করতে গিয়ে চর্যার সিদ্ধাচার্য কবিরা
যে রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পের ব্যবহার করেছেন তা তৎকালীন সমাজ, প্রকৃতি ও জীবনের রসসিক্ত
খন্ডচিত্র- যা চর্যাপদকে সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
•
প্রকৃতি বর্ণনা: চর্যাপদের পদগুলির মধ্যে গভীর গূঢ় অর্থ
থাকলেও তার বাইরের সাধারণ অর্থে বহুপদে শ্যাম-তন্বী বঙ্গ প্রকৃতির নির্মল চিত্র ফুটে
উঠেছে। তার নমুনা চর্যার ২৮ সংখ্যক পদটিতে মেলে-
“উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী
মোরঙ্গ পীচ্ছ পরহিন সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী”
পদটিতে শবরী বালিকার
প্রেক্ষাপটে চারপাশের আকাশ-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, শ্যামল বৃক্ষশোভা, বর্ণময় ফুল এমনকি
সোনালী রোদের প্রতিফলন যেন পাহাড়ি বন্য প্রকৃতির অসাধারণ চিত্ররূপ- যা আধুনিক সাহিত্যের
প্রকৃতি বর্ণনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
•
রূপক, প্রতীক চিত্রকল্প: রূপক,প্রতীক ,চিত্রকল্প ব্যবহারেও
চর্যাপদ সাহিত্য গুণান্বিত হয়ে উঠেছে।
“টালত ঘর
মোর নাহি পড়বেষী” অথবা “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”- প্রভৃতি পদের পংক্তিতে
পংক্তিতে রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
• আখ্যানধর্মীতা: আখ্যানধর্মীতা চর্যাপদের সার্থক সাহিত্য হয়ে ওঠার আরেকটি
কারণ। চর্যার কোনো কোনো পদে আখ্যান বা কাহিনির সন্ধান
মেলে। ৫০ সংখ্যক পদে চাঁচের বেড়া দেওয়া ঘরে শবর বালিকার জীবনচিত্র কাহিনীর মতো উপস্থাপিত
হয়েছে।
• বাস্তব জীবনচিত্র: “যথার্থ সাহিত্য জীবন সম্ভব”। চর্যার ১৯ সংখ্যক-
“কাহ্ণ ডোম্বী
বিবাহে চলিআ” পদে বিবাহ এবং মর্তমানবের দেহাসক্ত প্রেমের চিত্র, “টালত ঘর
মোর” পদে দরিদ্র মানবের বাস্তব চিত্র অংকিত হয়েছে। যে বাস্তব জীবনচিত্র বা বাস্তবতা
আধুনিক সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ, চর্যাপদে ও সেই মর্মগ্রাহী বাস্তব জীবনচিত্রের অভাব
নেই।
•
অলংকার: চর্যার কবিরা কথার সজ্জায়, আলংকারিক উজ্জ্বলতায়
চর্যাপদ গুলিকে কবিতারস সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। অনুপ্রাস, শ্লেষ, সমাসোক্তি প্রভৃতি অলংকারের সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে চর্যাপদে।
• ছন্দ: শুধু অলংকারের কারুকার্যে নয়, ছান্দসিক সাবলীলতায় ও চর্যাপদ গুলি
আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মাত্রা সমতার কিছু অসংগতি থাকলেও পয়ার, ত্রিপদী ছন্দের ব্যবহার
চর্যাপদ গুলির নির্মিতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
• উপসংহার: উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করে বলা যায় যে বৌদ্ধ সাধন সংগীত
হলেও চর্যাপদ আদর্শ সাহিত্য হয়ে উঠেছে। চর্যার ভাব ও রূপ সাহিত্য গুণের দিক থেকে উৎকৃষ্ট
ছিল বলেই পরবর্তী সাহিত্যে তাঁর স্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল। ডক্টর ভূদেব চৌধুরী যথার্থই
মন্তব্য করেছেন- “অষ্টাদশ
শতকের শাক্ত সঙ্গীত ও শ্যামাগীতি যে কারণে এবং যে অর্থে উৎকৃষ্ট গীতি সাহিত্য, সেই কারণে এবং
সেই অর্থেই চর্চাপদাবলী ও সার্থক সাহিত্যসৃষ্ট”।
- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সমাজচিত্র বা সামাজিকতা বর্ণনা করো
- রামায়ণের শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে কৃত্তিবাস ওঝার কৃতিত্ব
- কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব
- মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে? তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করো
- চর্যাপদের বিষয়বস্তু কি?
- চর্যাপদের সমাজচিত্র বর্ণনা দাও
- চর্যাপদ এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আলোচনা করো
- চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য অথবা কাব্যমূল্য বিচার করো