তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের রোমান্টিকতা ও বাস্তবতার টানাপোড়েন নিয়ে আলোচনা
ভূমিকা: সাহিত্য বাস্তবতার বৃন্তে রোমান্টিকতার পাপড়ির বিকাশ। বাস্তবতার আকাশে রোমান্টিক কল্পনার ডানায় ভেসে চলা।তবে কোথাও বা সুদুরবিহারী আবেগ, প্রকৃতির হাতছানি, কৌতুহল প্রবণতা, কল্পনার মায়াজাল বিস্তার প্রাধান্য পায়। আবার কোথাও বা বাস্তবতার কঠিন বাঁধনে অবরুদ্ধ হয় তার গতি। “তেলেনাপোতা আবিষ্কার” গল্পের এই রোমান্টিকতা এবং বাস্তবতার টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়।
রোমান্টিকতা:
রোমান্টিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রকৃতি প্রেম, আবেগ, কৌতূহল ও কল্পনা প্রবণতা। গল্পটিতে লেখকের প্রকৃতি বর্ণনা পুরো গল্পটি জুড়ে রোমান্টিকতার আবেগ সৃষ্টি করেছে। দুর্গম বনপথের বর্ণনা, গ্রাম্য পরিবেশ, প্রকৃতি, তার সুষুপ্ত রাতের রহস্যময়তা কবির রোমান্টিক বর্ণনায় পাঠকের দৃষ্টি পথে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শুধু প্রকৃতি বর্ণনা নয়, গল্পটিতে আবেগপ্রবণতার ও অভাব নেই। নিরঞ্জনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, যামিনির জীবনের দুর্ভাগ্য, কন্যাকে পাত্রস্থ করার জন্য বৃদ্ধা অশক্ত মায়ের দুশ্চিন্তা কথক-শ্রোতা পাঠক সবাইকে আচ্ছন্ন করে দেয়। তাই গল্পের নায়ক যামিনীকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে। যামিনী মায়ের দুঃখময় কথাগুলো শুনে চোখের জল গোপন রাখতে পারেনা।
কল্পনা প্রবণতাও এই গল্পে নানা স্থানে আপন অস্তিত্ব ঘোষণা করে। রাতের নির্জন নিস্তব্ধতায় জীর্ণ ছাদে দাঁড়িয়ে নায়কের মনে হয়- “এই মৃত্যু সুষুপ্তিমগ্ন মায়াপুরীর কোন গোপন প্রকোষ্ঠে বন্দিনী রাজকুমারী সোনার কাঠি রুপার কাঠি পাশে নিয়ে যুগান্তরের গাঢ় তন্দ্রায় অচেতন”। এই কল্পনার সাথে আবার মিশেছে নায়কের অসীম কৌতূহল। যা নিবৃত্ত করতে সে রাতের অন্ধকারে ছাদে পদচারণা ও প্রকৃতি দর্শন করেছে।
বাস্তবতা: পুরো গল্পটি যেমন রোমান্টিকতার কোমল স্পর্শে সিক্ত, তেমনি এর চরিত্র সৃষ্টি, ঘটনা সংস্থাপন এবং মানব মনের রহস্য উন্মোচনে বাস্তবতার তপ্ত পরশ বর্তমান। গল্পের যামিনী, যামিনীর মা,গ্রাম বাংলার দুঃখী- দরিদ্র নিসঙ্গ জীবনের প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। তাদের জীবনের এই বিষাদখিন্ন অনিঃশেষ অসহায়তার রূঢ় বাস্তবতা আমাদের হৃদয়কে বিক্ষত করে। অন্ধ অশক্ত মায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, যামিনীর বিবাহিত জীবনের প্রত্যাশা দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে চিরন্তন বাস্তব হয়ে উঠেছে।
আবার নায়ক চরিত্রটি শহুরে হলেও যামিনী কে বিবাহ করার প্রতিশ্রুতি দানের মধ্যে তার চরিত্রের যে আবেগ বিহ্বলতা তাও সেই সিচুয়েশনে অবাস্তব বলে মনে হয় না। লেখক রোমান্টিক চরিত্রগুলিকে বাস্তবতা থেকে সরিয়ে আনেননি।
তেলেনাপোতা কাল্পনিক গ্রাম হলেও লেখকের বর্ণনায় যেন সব গ্রামই হয়ে উঠেছে তেলেনাপোতা- তেমনি অসচ্ছল, অসহায়, দরিদ্র পীড়িত অথচ সত্য।আবার মানবমনের যে রহস্য ফুটে উঠেছে মিথ্যা নিরঞ্জন (নায়ক) ও সত্য নিরঞ্জনের চরিত্রে তা অবাস্তব নয়। মানুষ আবেগের বশে বা পরিস্থিতির চাপে কথা দেয় কিন্তু বাস্তবের তীব্র আঘাতে সে প্রতিশ্রুতি প্রতিশ্রুতিই রয়ে যায়। এ আজকের দিনেও চরম বাস্তব।
সিদ্ধান্ত: আসলে গল্পটি রোমান্টিক ভাবপ্রধান হলেও গল্পের ঘটনা, কাহিনী, চরিত্র সবই রোমান্টিকতা ও বাস্তবতার টানাপোড়েনে আবর্তিত। ইংরেজ কবি শেলী, কীটস প্রমুখ কবিতায় নিজেদের একটি স্বপ্নময় জগত তৈরি করতেন এবং পরে বাস্তবে ফিরে আসতেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র তেমনই একটি পরিস্থিতির রূপনির্মাণ করেছেন। রোমান্টিকতা ও বাস্তবতার নিগূঢ় সহাবস্থানে গল্পটি শিল্প সার্থক।