মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে? তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করো। কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব |

img title


কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব

 

মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস। তার রচিত গ্রন্থটির নাম “ভারত
পাঁচালী”। জনমানসে তা “কাশীদাসী মহাভারত” নামেই পরিচিত।

কবি পরিচিতি: বর্ধমান জেলার কাটোয়া অঞ্চলের “সিঙ্গি” মতান্তরে
“সিদ্ধি” গ্রামে কায়স্থ দেব পরিবারে মহাকবি কাশীরাম দাসের জন্ম। পিতার নাম
কমলাকান্ত। কবি বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী এবং সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর জন্মকাল নিয়ে
মতভেদ আছে। কেউ মনে করেন ষোড়শ শতকের শেষে আবার সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে তার জন্ম
বলে অনুমান করেছেন।


রচনাকাল: কাশীরামের কোনো কোনো পুঁথিতে “ভারত পাঁচালীর”
রচনাকালের
  সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সমস্ত তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে। সমালোচকগণ মনে করেন
ষোড়শ শতকের শেষভাগ অথবা সপ্তদশ শতকের একেবারে প্রথম লগ্নেই গ্রন্থটি রচিত।

গ্রন্থ পরিচয়: আঠারোটি পর্বে রচিত মহাভারতে একটি বিশাল যুগের সমাজ ও জীবনাদর্শ
অতি উজ্জ্বল বর্ণের চিত্রিত হয়েছে।

পঞ্চপান্ডবের কীর্তিকথা,
কৃষ্ণের মহিমা, কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে দুর্যোধন সহ শত ভাইয়ের বিনাশ এবং অবশেষে
পান্ডবদের স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠালাভ এই মহাকাব্যের মূল বিষয়। তবে গ্রন্থটি কবি নিজে
সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। পরবর্তীকালের কবিদের হাতেই যে গ্রন্থটি পূর্ণতা লাভ করেছিল
সে পরিচয় সুস্পষ্ট।

 

মূল্যায়ন বা কৃতিত্ব :

“মহাভারতের কথা অমৃত সমান

হে কাশী, কবীশদলে  তুমি পুণ্যবান”।

– মধুসূদন

চৈতন্য পরবর্তী
যে দু একজন কবি মহাভারতের মহাসমুদ্র সন্তরণ হওয়ার প্রচেষ্টা করেছিলেন তাদের মধ্যে
কাশীরাম দাস অন্যতম।

          কাশীরাম দাসের “ভারত পাঁচালী” অনুবাদ হলেও তা আক্ষরিক অনুবাদ
নয়- ভাবানুবাদ বা সারানুবাদ। গ্রন্থটিতে কবির স্বকীয়তা বা মৌলিক প্রতিভার পরিচয়
সুমুদ্রিত। বিভিন্ন পুরান- উপপুরাণ,জৈমিনি মহাভারতের আখ্যান এবং কিছু স্বরচিত কাহিনী
এখানেই স্থান পেয়েছে। সাধারণ মানুষের রস তৃষ্ণা চরিতার্থ করার জন্য তিনি তত্ত্ব দর্শন
ও নীতি কথা বাদ দিয়ে গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে কাহিনীকে দেশ- কাল ও বাঙালি মনের উপযোগী
করে তুলেছেন।

 

            এর ঘটনা অতি জটিল। ধর্মাধর্মের সংঘাতে রণভূমি প্রকম্পিত। ন্যায়-নীতি-
রাজ ধর্ম -প্রজাধর্ম, দর্শন প্রভৃতি নিপুণতার সঙ্গে গ্রথিত হয়ে মহাকাব্যটিকে জটিল
স্বার্থসংঘাতে উচ্চকিত এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার অগ্নিশুদ্ধ জাতির জীবন কাব্যের মহিমা দান
করেছে।

                চৈতন্যদেবের প্রভাবে গ্রন্থটিতে কৃষ্ণ প্রেমের ছড়াছড়ি। একইসাথে যুগ চাহিদা
পূরণ করতে গিয়ে বীররসের পরিবর্তে ভক্তি রসের প্রাধান্য ঘটেছে।

মহাভারতে কবির অসাধারণ বর্ণনকুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। অর্জুনের রূপ-সৌন্দর্য
বর্ণনায় শ্যাম-কান্তি প্রকাশিত-

“অনুপম অনুশ্যাম নীলোৎপল আভা।

মুখরুচি কত শুচি করিয়াছে শোভা”।

অথবা কৃষ্ণের বিশ্বরূপ
বর্ণনায় সংস্কৃত শব্দের দ্যোতনায় ক্লাসিক সমুন্নতি সাধিত হয়েছে।

 

               মহাভারতের ঘটনাবিন্যাসে, নাটকীয়তা নির্মাণে, সরস উক্তি প্রত্যুক্তিতে
ও হাস্যরস পরিবেশনেও কবির কৃতিত্বের ছাপ রয়ে গেছে।

 

          কৃত্তিবাসের বাঙালিয়ানা কাশীদাসী মহাভারতে নেই। কিন্তু কবি সামাজিক ও
পারিবারিক আদর্শ,ধর্মপ্রাণতা, নৈতিকতা, অতিথিসেবা, জীবে দয়া ও স্বার্থ ত্যাগের মহিমা
প্রচার করে বাঙালিকে উদার মানবধর্মে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছেন।

            তৎসম শব্দবহুল ভাষার কাঠিন্য ও কিছু কৃত্রিমতার কারণে গ্রন্থটি রামায়ণের
মতো জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে জনমানসে কবি কাশীরাম কৃত্তিবাসের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
পয়ার,ত্রিপদী ছন্দের বন্ধনে, অলংকারের নিপুণ প্রয়োগে, মহাকাব্যিক আঙ্গিক ও পরিবেশে
ঐশ্বর্যময় হয়ে গ্রন্থটি কালোত্তীর্ণ।

মহাভারতের অমৃত
বাণী বুকে ভরে বাঙালি আজও জীবনের রাঙামাটির পথ ধরে অমৃতলোকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়।



Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *