
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের জীবনী ও কার্যাবলী
এরান শিলালিপি থেকে জানা যায়, সমুদ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পিতার সিংহাসনে বসেন। গুপ্ত যুগের সর্বশেষ্ঠ নৃপতি সমুদ্রগুপ্ত অনন্য সাধারন সামরিক
প্রতিভার স্বাক্ষর রূপে ভারতের
বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ব্যাপী যে রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলেছিল, তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত
সামরিক বিজয়কে সম্পূর্ণতা দান করেন। এবং
সাম্রাজ্যের সংহতি ও সংগঠনকে সুদৃঢ় করেন। তিনি নরেন্দ্রচন্দ্র, সিংহচন্দ্র, নরেন্দ্র, সিংহ বিক্রম, দেবরাজ, দেবশ্রী নামে পরিচিত ছিল।
দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রসার ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য তিনটি নীতি অনুসরণ করেন। এগুলো হলো বৈবাহিক সম্পর্ক, সন্ধি ও যুদ্ধজয়। সমকালীন বিভিন্ন শক্তিশালী রাজবংশের সঙ্গে বৈবাহিক
সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে তিনি নিজ শক্তি ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করেন। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বলেন– ‘গুপ্ত বংশের
বৈদেশিক নীতিতে বৈবাহিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল’। তিনি মধ্য ভারতের শক্তিশালী নাগ বংশের
রাজকন্যা কুবের নাগাকে
বিবাহ করে নাগ বংশের সৌহার্য
অর্জন করেন। নর্মদার
দক্ষিণের শক্তিশালী বাকাটক রাজ্যের অধিপতি দ্বিতীয় রুদ্র সেনের সঙ্গে নিজ কন্যা
প্রভাবতী গুপ্তার বিবাহ দেন।
এছাড়া কুন্তল বা কর্ণাটকের কদম্ব বংশের রাজকন্যার সঙ্গে নিজ পুত্রের বিবাহ দেন। স্মিথ বলেন যে–“শকযুদ্ধের জন্য
নাগ ও বাকাটক বংশের মৈত্রী দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্তের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল”।
মালক,
গুজরাট ও সৌরাষ্ট্র রাজত্বকারী বিদেশি শকদের
পরাজিত ও বিতাড়িত করা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুরাগী দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্তের কাছে বিজাতীয় শব্দের উপস্থিতি অসহনীয় ছিল। এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পতাকা উড্ডীন করা এবং পশ্চিম উপকূলে গুজরাট বন্দর
থেকে রোম সাম্রাজ্য সঙ্গে বাণিজ্যের পথ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তিনি শক
যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শক রাজা তৃতীয়
রুদ্রসেন যুদ্ধে নিহত হন এবং শকরাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। শক শক্তিকে উচ্ছেদ করে দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত “শকারি” বা “শকদের শত্রু”
উপাধি ধারণ করেন। দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত তাঁর রাজধানী
উজ্জয়নী নিয়ে যায।
দিল্লি কুতুব মিনারের কাছে মেহেরৌলি গ্রামে একটি লৌহ স্তম্ভে উৎকীর্ণ তারিখবিহীন লিপি
থেকে জানা যায়– চন্দ্র
নামে জনৈক রাজা বঙ্গের নৃপতি বর্গের্তিএক সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত
করেন এবং সপ্তসিন্ধু অতিক্রম করে বাহ্লীক দেশ জয় করেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে চন্দ্র ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একই ব্যক্তি। সম্ভবত সমুদ্র
গুপ্তের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পুনরায় তা
জয় করেন। বাহ্লীক বলতে
অনেকে ব্যাক্ট্রিয়া মনে
করেন। বলাই বাহুল্য তার পক্ষে ব্যাক্ট্রিয়া জয় অসম্ভব ছিল। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
বলেন– এখানে সিন্ধু নদ অঞ্চলের উপজাতিদের বাহ্লীক বলা
হয়েছে।
অনেকে মনে করেন
উজ্জয়নী রাজ বিক্রমাদিত্য নামে যে রাজার নাম উল্লেখ আছে তিনি ও দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত একই ব্যক্তি। কিংবদন্তির
বিক্রমাদিত্য শকদের নিধনকারী
ছিলেন এবং উজ্জয়নী তার রাজধানী ছিল। দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্তের সম্পর্কে দুটি কথা মিলে যায়।
বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে তার রাজসভায় কালিদাস সহ নবরত্ন অনেক সদস্য ছিলেন এবং তিনি “বিক্রম সম্বতঁ” নামে একটি অব্দ প্রচলন করেন। মহাকবি কালিদাস দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের
সমসাময়িক হলেও অন্য সকল রচনা সবাই কখনো জীবিত ছিল না। তাছাড়া বিক্রম সম্বৎ 58 খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রবর্তিত হয় কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত খ্রিস্টীয়
চতুর্থ শতকের মানুষ। রমেশচন্দ্র মজুমদারের
মতে– বিক্রম সম্বৎ ও রাজা বিক্রমাদিত্যের যথাযথ পরিচয় ভারত ইতিহাসে একটি
অমীমাংসিত প্রশ্ন। এর সত্ত্বেও বলতে হয়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে বিক্রমাদিত্যের কাহিনী সংযুক্ত করা তাঁর
জনপ্রিয়তায় সাক্ষ্য বহন করে।
সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তার পিতার সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন
রাখতে সক্ষম হয়। শক যুদ্ধে
জয়লাভের দ্বারা সেই সম্রাজ্যকে পশ্চিমে প্রভাবিত করেছিল। তার মুদ্রাগুলি অধিকাংশ বিহার ও বাংলা থেকে আবিষ্কৃত
হয়েছে। 1883 সালে হুগলি জেলার মাধবপুর গ্রাম
থেকে তীর-ধনুক হাতে রাজমূর্তি
যুক্ত পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। 1894 সালে মুজাফফরপুর জেলায় হাজীপুর গ্রামে
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামাঙ্কিত তিন ধরনের স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া যশোর জেলার মহম্মদপুর গ্রামে, ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জে, পাটলিপুত্র
খননের সময় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামাঙ্কিত কয়েকটি তাম্রমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়।
গুপ্ত বংশের
ইতিহাসে যদি সমুদ্র গুপ্তকে সাম্রাজ্যের
শ্রেষ্ঠ বিস্তার কর্তা বলা
হয়, তাহলে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কে
নিশ্চয়ই তাঁর শ্রেষ্ঠ স্থপতি রূপে অভিহিত করা যেতে পারে। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি যে সাম্রাজ্য
পেয়েছিলেন সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি তা সুসংহত করেন। দেশজুড়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির ফলশ্রুতি হিসেবে সাম্রাজ্যে বৌদ্ধিক
ও সংস্কৃতিক কার্যকলাপের সূচনা হয়।
তিনি বিদ্যা ও বিদ্ধানের পৃষ্ঠপোষকতা ছিলেন। তথাকথিত স্বর্ণযুগের উৎকর্ষতা তাঁর সময় পরিলক্ষিত হয়। কালিদাস তার সমসাময়িক ছিলেন এবং নবরত্ন অনেকেই তার সভায়
অলংকৃত করতেন। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে
চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে এক নতুন অধ্যায়।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একজন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ছিলেন এবং তার উপাধি ছিল “পরম ভগবত”। ধর্মবিশ্বাসে বৈষ্ণব হওয়া সত্ত্বেও
তিনি পরধর্মমত সহিষ্ণু ছিলেন। সামগ্রিকভাবে
বলা যায় রাজনৈতিক মহত্ব ও সংস্কৃতিক পুনজাগরণকে পূর্ণতা দান করে তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যকে অমর করে তুলেছিলেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এর ভাষায়-“He brought ta the maturity the new era of political greatness and won a
place in the hearts of people”.