দর্শন বলতে কী বোঝো? দর্শনের বৈশিষ্ট্য | দর্শন ও বিজ্ঞানের সাদৃশ্য | “দর্শনের প্রত্যয়”- পাশ্চাত্য দর্শন |


1. Philosophy (ফিলোসোফি) শব্দের অর্থ কি?

 

ইংরেজি “Philosophy” শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ
থেকে আগত। গ্রিক শব্দ “philos” মানে হল অনুরাগ এবং “sophia” শব্দটির
অর্থ হল জ্ঞান। সুতরাং শব্দের ধাতুগত অর্থ হলো জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ (Love of
wisdom) বা সত্যের প্রতি অনুরাগ।

 

2. দর্শন বলতে কী বোঝো?

দর্শনের পরিসর এত ব্যাপক বা বিস্তৃত এবং বিভিন্ন দার্শনিক
বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দর্শনের সংজ্ঞা বিভিন্ন নির্দেশ করার ফলে দর্শনের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য
সংজ্ঞা মেলে না।

 

     গ্রিক দার্শনিক
সক্রেটিসের ভাবশিষ্য প্লেটো বলেছেন “বিস্ময়ই দর্শনের জনক” অর্থাৎ বিস্ময়
থেকেই যে অসংখ্য জিজ্ঞাসার উৎপত্তি তার উত্তর দিতে দর্শন সচেষ্ট হয়। তিনি আরো বলেছেন
“দর্শনের লক্ষ্য হল যা চিরন্তন বাস্তব বা মূল সত্ত্বা তার প্রকৃতি সম্বন্ধে সার্থক
জ্ঞান অর্জন করা”।

 

         অ্যারিস্টটল
ও ঠিক একই কথা বলেছেন “সত্ত্বার নিজস্ব স্বরূপ কি এবং স্বরূপ অনুযায়ী কি কি ধর্ম
এতে আছে তার বৈজ্ঞানিক আলোচনা হচ্ছে দর্শনের কাজ
“। অর্থাৎ প্লেটো ও অ্যারিস্টটল
উভয়েই দর্শনকে অধিবিদ্যার সঙ্গে অভিন্ন মনে করেছেন। যদিও দর্শন ও অধিবিদ্যা অভিন্ন
নয়।

        দার্শনিক
কোঁতে বলেছেন “দর্শন হল সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান“।

        দার্শনিক
পলসন বলেছেন “দর্শন হল সকল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমষ্টি“।

          দার্শনিক
হল্ড বলেছেন “বিভিন্ন বিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞানকে একটি সুসামঞ্জস্য সমাদ্রতার একীভূত
করাই হলো দর্শন
“।

      হার্বাট
স্পেন্সার
বলেছেন “দর্শন পরিপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ জ্ঞান। দর্শনের সামান্যীকরণগুলি বিজ্ঞানের
ব্যাপকতর সামান্যীকরণগুলি উপলব্ধি করে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ এই সংজ্ঞাগুলি দর্শনকে বস্তুত
বিজ্ঞানের একীভূত রূপের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে একভূত
করাই দর্শনের একমাত্র কাজ”।

         কান্টের
মতে “দর্শন হলো জ্ঞান সম্পর্কিত বিজ্ঞান এবং তার সমালোচনা“।

        থ্রিকেট
বলেছেন “দর্শন হল জ্ঞান সম্পর্কিত বিজ্ঞান“।


           মারাভন
বলেছেন “দর্শন হল সত্যের প্রতি অনুরাগ। সব সভ্যতা তার অন্তর্ভূত এমন জ্ঞানের পূর্ণ
ভান্ডার যাতে সব সভ্যতা এক মহান অখণ্ডতার মধ্যে সুবিন্যস্ত”।

           দার্শনিক
ওয়েবার বলেছেন “দর্শন হল প্রাকৃতিক বিষয়ে এক সামগ্রিক দৃষ্টি লাভের অনুসন্ধান,
বস্তুর ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা”।

         দর্শনের
মোটামুটি সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে দর্শন হল এমনই একটি ব্যাপক
শাস্ত্র যা বিভিন্ন বিজ্ঞান থেকে তথ্য নিয়ে এবং জ্ঞানের শর্ত ও সম্ভাবতায় বিচার করে
সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎ ও জীবনের স্বরূপ, বস্তুর বাহ্যরূপ ও অন্তর্নিহিত মূল
তত্ত্ব বা চরম সত্ত্বা সম্পর্কে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে এবং পরমমূল্যের আলোকে তাদের
মূল্যায়ন করে।

 

3. দর্শনের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।

a. দর্শন হলো জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা পরম সত্যের অনুরাগ।

 

b. দর্শন জ্ঞানের উৎস,স্বরূপ, শর্ত, সীমা, সম্ভাবনা
ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে।

 c. দর্শন অবভাষিক
জগৎ নিয়ে যেমন আলোচনা করে তেমনি পরমতত্ত্বের সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করতে চায়।

 d. দর্শনের
দৃষ্টিভঙ্গি হল সামগ্রিক বা অখন্ড দৃষ্টিভঙ্গি।

 

 e. দর্শন শুদ্ধ
বিচারবুদ্ধির আলোকে সত্যকে জানতে চায়।

 

f. দর্শনের পদ্ধতি হলো বিচারমূলক পদ্ধতি। যার মাধ্যমে
আলোচ্য বিষয়ের যুক্তি গ্রাহ্য, বুদ্ধি গ্রাহ্য ও সর্বাধিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়।

 

 g. দর্শনের
কাজ হল বিষয়বস্তুর সার্বিক ও সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভ করা।

 

h. জগৎ ও জীবন এবং জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল দর্শনের
আলোচ্য বিষয়।


 i. বিজ্ঞান
কতগুলি মৌলিক শতকে বিনাবিচারে প্রকল্প হিসেবে মেনে নেয়। দর্শন বিজ্ঞান স্বীকৃত সেই
প্রকল্পগুলির সত্যতা নিরূপণ করতে চায়। তাই দর্শন হল বিজ্ঞানের ভিত্তি।

j. এক পরম কল্যাণের আদর্শের আলোক আত্মসচেতন জীব হিসেবে
মানুষের আচরণের ঐচ্ছিক ক্রিয়া ও অভ্যাসগত ক্রিয়ার নৈতিক মূল্যবিচার দর্শনের অন্যতম
কাজ।


4. দর্শন ও বিজ্ঞানের সাদৃশ্য গুলি আলোচনা করো।


a. বিজ্ঞান
ও দর্শন উভয়ই জগৎ ও জীবনের বুদ্ধি গ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে।

b. উভয়ের উদ্দেশ্য হলো সত্য অনুসন্ধান।

c. উভয় এর
লক্ষ্য হলো অভিজ্ঞতালব্ধ বৈচিত্র্যকে ঐক্যবদ্ধ করা।
 

d. দর্শন বিজ্ঞান
স্বীকৃত প্রকল্পগুলির যৌক্তিকতা বিচার করে যথার্থতা দান করে।


5. দর্শনের প্রধান প্রধান কয়েকটি শাখা সম্পর্কে আলোচনা
করো।

জ্ঞান বিদ্যা:  ইংরেজি
“Epistemology” কথাটি দুটির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। একটি হল
Episteme” এবং অন্যটি “logia“। “Episteme” কথাটির অর্থ
হল জ্ঞান এবং “logia” কথাটির অর্থ হল বিদ্যা বা বিজ্ঞান।

      সুতরাং
Epistemology কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়ায় জ্ঞানবিদ্যা। দর্শনের যে শাখায় জ্ঞানের
উৎপত্তি এবং তার প্রকৃতি,সীমা এবং বৈধতা নিয়ে আলোচনা করে তাকে জ্ঞানবিদ্যা বলে অভিহিত
করা হয়।

 দর্শন এবং জ্ঞানবিদ্যার
সম্পর্ক খুবই নিবিড়। দার্শনিক আলোচনায় প্রারম্ভিক জ্ঞান বিদ্যার আলোচনার প্রয়োজন।
জ্ঞানবিদ্যার ভিত্তির উপর দর্শনের তত্ত্ব আলোচনার সৌধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাই জ্ঞান
বিদ্যা হল দর্শনের একটি শাখা।

অবভাসিক বিদ্যা: জাগতিক বিষয়সমূহ আমাদের কাছে যেভাবে প্রতিভাত হয় সেটা
হল বস্তুর বাহ্য  বা অবভাসিক রূপ। দর্শনের যে
শাখা বস্তুর এই অবভাসিক রূপটি নিয়ে আলোচনা করে তাকে বলা হয় অবভাসিক বিদ্যা।

 

অধিবিদ্যা: অধিবিদ্যা বা “Metaphysics” কথাটির অন্তর্গত
“Meta” কথাটির অর্থ পরে এবং “physics” কথাটির অর্থ পদার্থবিদ্যা।
সুতরাং বুৎপত্তিগত অর্থে “Metaphysics” হল সেই দার্শনিক আলোচনা যা দৃশ্যমান
অবভাসিক পদার্থ বিদ্যার পরে আসে। সুতরাং দর্শনের যে শাখা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নিয়ত পরিবর্তনশীল
জগতের অন্তরালে কোনো অতীন্দ্রিয় পরমসত্তা আছে কিনা অন্বেষণ করে তাকে অধিবিদ্যা বলে।
তাই ঈশ্বর,আত্মা, অমরতা ইত্যাদি অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়।

মূল্যবিদ্যা: সকল বিষয়ে মূল্যাবধারণ দর্শনের একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। সত্য,শিব
এবং সুন্দরের আদর্শে আমরা বিভিন্ন বিষয়ের মূল্যায়ন করি। এই তিনটি আদর্শের সঙ্গে যুক্ত
আছে আমাদের তিনটি প্রধান মানসিক চিন্তা, অনুভূতি এবং ইচ্ছা। চিন্তার আদর্শ হল সত্য।
সত্যের আলোকে আমরা চিন্তা তথা যুক্তির বিচার করি।ইচ্ছা বা সংকল্পের আদর্শ হলো শিব বা
কল্যাণকর। অনুভবের আদর্শ হলো সুন্দর।

আমরা সুন্দরকে অনুভব করতে চাই।দর্শনের অন্যতম শাখা হিসেবে
মূল্যবিদ্যা এইসব মূল্য সংক্রান্ত আলোচনা করে। তাই মূল্যবিদ্যা তিনটি শাখার মাধ্যমে
এই কাজগুলি করে।যেমন-

১. যুক্তিবিজ্ঞান চিন্তার আদর্শ হিসেবে সত্যের স্বরূপ
আলোচনা করে।

২. নীতি বিজ্ঞান একটি পরম কল্যাণের আদর্শে আত্মসচেতন
হিসাবে মানুষের আচরণের ঐচ্ছিক ও অভ্যাস জাতীয় ক্রিয়ার ভালো-মন্দ,চিত্য-অনৈচিত্য ইত্যাদির
মূল্য নিরূপণ করে। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা হেতু পরম কল্যাণের আদর্শ হিসাবে সুন্দর স্বরূপটি
আলোচনা করে মূল্যবিদ্যা।

 

ধর্ম-দর্শন: “ধৃ” ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের ব্যুৎপত্তি। যা জীবনে
সত্যকে ধারণ করে তাই ধর্ম। কিন্তু ধর্মীয় আচার আচরণ ও ধর্মীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে
থাকে এক অতীন্দ্র সর্বজ্ঞা সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় ঈশ্বর। যিনি মানুষের আনুগত্য,শ্রদ্ধা
ও পূজা পাওয়ার অধিকারী।

       ধর্ম
দর্শন হলো দর্শনের সেই শাখা যা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্মের সমাপ্ত দিকগুলিকে
বিচার-বিশ্লেষণ করে।

           
ধর্ম দর্শনের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মায়েল এডওয়ার্ডস তাঁর “The
philosophy of religion” গ্রন্থে বলেছেন- ধর্ম দর্শন হলো ধর্ম সম্বন্ধীয় অভিজ্ঞতার
স্বরূপ, ক্রিয়া, মূল্য, সত্যতা এবং পরম তত্ত্বের স্বরূপ হিসেবে ধর্মের অনুসন্ধান।

 

সমাজ দর্শন: সমাজ দর্শন হল সমাজ বিষয়ক দার্শনিক আলোচনা। দর্শনের উপাদান
সংগ্রহ করে যে সকল মৌলিক আদর্শ সামাজিক বিকাশ ও বিবর্তনকে পরিচালিত করেছে, সেগুলির
স্বরূপ অনুসন্ধান করা এবং পরমতত্ত্ব ও আদর্শ সমূহের দন্ডে সমাজের যাবতীয় ঘটনা, আচরণ,রীতিনীতি
ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের চরম মূল্য এবং উদ্দেশ্য দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্ধারণ করে
যে দর্শন তাকে সমাজদর্শন বলে।

       তাই গিসবার্ট
বলেছেন সমাজ দর্শন হল সমাজ বিজ্ঞান ও দর্শনের মিলনস্থল।


মনোবিদ্যা: মনোবিদ্যা হল দর্শনের সেই শাখা যা মন কি, মানসিক ক্রিয়াগুলি
কি কি, মনের বিভিন্ন স্তর এবং কিরূপ মানসিক পরিস্থিতিতে জীব কিরূপ আচরণ করে ইত্যাদি
নিয়ে আলোচনা করে তাকে মনোবিদ্যা বলে।

 

1 thought on “দর্শন বলতে কী বোঝো? দর্শনের বৈশিষ্ট্য | দর্শন ও বিজ্ঞানের সাদৃশ্য | “দর্শনের প্রত্যয়”- পাশ্চাত্য দর্শন |”

  1. Pingback: দর্শন শব্দের অর্থ | ভারতীয় দর্শন | Class -11, Semester 1 | P-2, Philosophy Notes - Class Ghar

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top