পরিবেশ (Environment) শিক্ষাবিজ্ঞান | শিশুর বিকাশে পরিবেশের ভূমিকা

পরিবেশ
(Environment)

পরিবেশের সংজ্ঞা
(Definition of Environment)
: শিক্ষাবিজ্ঞানে পরিবেশ বলতে বোঝায় সেই সমস্ত পারিপার্শ্বিক
অবস্থার প্রভাব যা শিশুকে সর্বাঙ্গীন বিকাশে এবং আচরণের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে।
আধুনিক অর্থে শিক্ষা ও পরিবেশ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই শিশুর শিক্ষা
ও উপযুক্ত বিকাশ ঘটানোর জন্য শুধু ব্যক্তিসত্ত্বার গুণই যথেষ্ট নয়, উপযুক্ত পরিবেশেরও
প্রয়োজন।

বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী,
শিক্ষাবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদগণ শিক্ষাবিজ্ঞানে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিবেশের সংজ্ঞা দিয়েছেন।
মনোবিদ সি. স্টোন (C. Stone) বলেছেন—জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে সমস্ত উদ্দীপক
(stimualus) কোনো ব্যক্তিকে উদ্দীপ্ত করে তাদের সমবায়কেই পরিবেশ বলা হয়।



উডওয়ার্থ
(Woodworth)-এর মতে, “পরিবেশ বলতে সমস্ত বাহ্যিক উপাদানকে (external factors) বুঝিয়ে
থাকে যা জীবনের শুরু থেকে শিশুর ওপর ক্রিয়াশীল থাকে”। মনোবিদ ডগলাস ও হল্যান্ড
(Douglas and Holland) বলেছেন—যে সমস্ত বাহ্যিক শক্তি, তাদের প্রভাব এবং অবস্থান দ্বারা
জীবনের প্রকৃতি, আচরণ, (nature and behaviour of life) তার বিকাশ ও বুদ্ধি এবং পরিণমনকে
(development, inteligence and maturation) প্রভাবিত করে, তাদের সমবায়কে বলা হয় পরিবেশ।

 

শিক্ষাবিজ্ঞানে পরিবেশের বৈশিষ্ট্য
(Characteristics of Environment) শিক্ষাবিজ্ঞান  :


পরিবেশ সম্পর্কে
স্পষ্ট ধারণা করতে গেলে পরিবেশের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই বৈশিষ্ট্যগুলি
হল—

(১) সক্রিয়তা : ব্যক্তির জন্মগত সত্ত্বার বাইরে যে
সমস্ত বিষয় শিশু বা ব্যক্তিকে উদ্দীপ্ত করে তাই হল পরিবেশের অঙ্গ। এ প্রসঙ্গে বলা
যায় পরিবেশ কোনো নিষ্ক্রিয় সত্ত্বা নয়, বরং একটি সক্রিয় সত্ত্বা (Active
entity)। যেমন—একটি শিশুর কাছে খেলনা দেওয়া হলে সেগুলি নিয়ে আপন মনে সে খেলা করে।
কারণ খেলনা, গাড়ি এগুলি শিশুদের উদ্দীপ্ত করেছে। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের এই
সামগ্রী উদ্দীপ্ত করতে পারে না, তাই ওগুলি অন্যান্য সদস্যদের কাছে পরিবেশ নয়।

(২) ব্যাপকতা : শিক্ষার মতো পরিবেশও জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।
পরিবেশ কোনো সংকীর্ণ বা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। ব্যক্তিজীবনের ব্যাপকতা যতটুকু, পরিবেশের
ব্যাপকতাও ততটুকু।

(৩) পরিবর্তনশীলতা : পরিবেশ সব সময় পরিবর্তনশীল। এই
পরিবর্তনশীলতার জন্য শিশুর বৃদ্ধি (Growth), বিকাশ Development), আচরণ প্রভৃতি উন্নতি
লাভ করে।

(৪) শক্তি সঞ্চার : আধুনিক অর্থে, পরিবেশের
সকল অংশ ব্যক্তিকে সক্রিয় করে তোলে। তাই পরিবেশই শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত। এই দিক
থেকে পরিবেশ শক্তি সঞ্চারক।

(৫) উন্নয়নমুখী : মনোবৈজ্ঞানিক দিক থেকে বলা যায়,
ব্যক্তির পরিবেশ তার মধ্যে যে সক্রিয়তা আনে, তার দরুণ ব্যক্তির বৃদ্ধি (Growth), বিকাশ
(Development), আচরণগত পরিবর্তন, পরিণমন ইত্যাদি উন্নয়নমূলক প্রক্রিয়াগুলি সংঘটিত
হয়।

(৬) ব্যক্তিনির্ভর : পরিবেশ শুধুমাত্র
বস্তু নির্ভর ধারণা নয়, ব্যক্তিনির্ভর ধারণাও বটে। বস্তুগত পরিবেশ বা অবস্থা সকল সময়ই
ব্যক্তির উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত মাত্রা লাভ করে।

(৭) গতিশীলতা : পরিবেশ সর্বদা গতিশীল, প্রতিটি মুহূর্তে
পরিবেশের মধ্যে পরিবর্তন ঘটছে। সদা পরিবর্তনশীল এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য
মানুষকে তাই প্রতি মুহূর্তেই সচেষ্ট থাকতে হয়।

(৮) ব্যক্তির মধ্যে পরিবর্তন: পরিবেশের উপাদান
যেহেতু সদা পরিবর্তনশীল, তাই মানুষকে সেই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজের
আচার-আচরণকেও প্রয়োজনমতো বদলাতে হয়।

(৯) ধারাবাহিকতা: পরিবেশের আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল ধারাবাহিকতা।
মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে ততদিনই তাকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়।

(১০) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া : পরিবেশ সজীব ও
নির্জীব উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। মানুষ পরিবেশের সজীব উপাদান। মানুষের সঙ্গে পরিবেশের
অন্যান্য উপাদানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই একটি আন্তঃক্রিয়া গড়ে ওঠে।

(১১) শক্তির সঞ্চার : পরিবেশের বিভিন্ন
উপাদান মানুষের মধ্যে শক্তির সঞ্চার করে। এই শক্তির প্রভাবেই মানবদেহে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয়
ক্রিয়া চলে। এই শক্তিই মানুষকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে সাহায্য

 

 

পরিবেশ শিক্ষার উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা
সংক্ষেপে আলোচনা করো।

 

পরিবেশশিক্ষার উপযোগিতা :

1.
জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ
: পরিবেশশিক্ষার দ্বারা স্থানীয় এবং পারিপার্শ্বিক
ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং তার মধ্যে বসবাসকারী প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য সম্পর্কে সম্যক
জ্ঞানলাভ করা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।

2.
সম্পর্ক নিরূপণ :
পরিবেশশিক্ষা থেকে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ভুক্ত জীবদের
মধ্যেকার সম্পর্ক নিরূপণ করা যায় এবং তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সাহায্য করা সম্ভব হয়।

3.
গঠনগত অভিযোজন সম্পর্কে ধারণা লাভ
: পরিবেশশিক্ষা থেকে কোনো নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক
পরিবেশে জীবের গঠনগত অভিযোজন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়, ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে এই
ধারণা বিশেষ কাজে লাগে।

4.
মানুষ-পরিবেশ সম্পর্ক :
পরিবেশশিক্ষা মানুষ এবং পরিবেশের সম্পর্ক সম্বন্ধে অবহিত
হতে সাহায্য করে। এর ফলে মানুষ এবং পরিবেশের পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়ে ওঠে।

5.
জীবজগতের উদ্ভবের জ্ঞান
: পরিবেশশিক্ষা থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে।
ক্রমশ কীভাবে জীবজগতের উদ্ভব ঘটেছে এবং পরবর্তীকালে বহু জীব বিলুপ্ত হয়েছে। জীবজগতের
অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এই জ্ঞান বিশেষ সাহায্য করে।

6.
মানুষের আচরণে পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে জ্ঞান
: পরিবেশশিক্ষা থেকে জানা যায় যে,
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন উপাদানকে নিজের কাজে লাগাচ্ছে এবং
তার ফলে পরিবেশের কী কী ক্ষতি হচ্ছে। ফলে পরিবেশকে আরও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা সহজ
হয়।

7.
দূষণের কারণ সম্পর্কে জ্ঞান :
পরিবেশশিক্ষা থেকে বিভিন্ন প্রকার দূষণের
কারণ জানা যায় এবং তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

8.
প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে জ্ঞান
: প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন এবং কীভাবে হয়
তাও জানা যায় পরিবেশশিক্ষা থেকে। ফলে এর প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা
সম্ভব হয়।

9.
জনস্বাস্থ্যের মান
: বিভিন্ন স্থানে জনস্বাস্থ্যের মান কেমন এবং কোন্ কোন্ কারণে
ওই মান হ্রাস পায়, কীভাবে জনস্বাস্থ্যের মান উন্নয়ন করা যায় তাও জানা যায় পরিবেশশিক্ষা
থেকে।

পৃথিবীকে মানুষের এবং অন্যান্য জীবের বসবাসের
উপযোগী করার জন্য কী কী প্রয়োজন তা পরিবেশ শিক্ষা থেকে জানা যায়। পরিবেশ শিক্ষা পৃথিবীতে
মানুষকে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করে।

 

 

শিশুর বিকাশে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকা


প্রকৃতির কোলে বসে
প্রভাত ও সন্ধ্যাকে, মেঘমুক্ত রাত্রির বিরাট আকাশকে অনুভবের মধ্যে যে বিরাটত্ত্বকে
পাওয়া যায় তা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। প্রকৃতিবাদী দার্শনিক রুশো মনে করেতেন,
“প্রকৃতিই মানুষের সর্বোত্তম শিক্ষক”। বর্তমানে প্রায় সকল শিক্ষাবিদ স্বীকার করেন
যে, প্রাকৃতিক পরিবেশ নানাভাবে শিশুর জীবন বিকাশে সহায়তা করে।


(ক) দৈহিক-বিকাশ : মানুষের জীবনধারনের জন্য অতি প্রয়োজনীয়
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, জল, আলো, বাতাস প্রভৃতি উপাদান মানুষ মূলত আহরণ করে প্রাকৃতিক
পরিবেশ থেকে। প্রভাতের সূর্যালোক, রাত্রির চন্দ্রাতাপ ও নির্মল প্রাণবায়ু ইত্যাদি
দেহ গঠনের যাবতীয় সামগ্রী মানুষ আবহমানকাল থেকে প্রকৃতির মধ্য থেকেই সংগ্রহ করছে।

(খ) বৌদ্ধিক বিকাশ : প্রকৃতির সংস্পর্শে
এসে শিশুর কল্পনা, সৃজনশীলমন, বুদ্ধি, চিন্তন ক্ষমতা, যুক্তিগ্রাহ্যতা প্রভৃতি গড়ে
উঠেছে। প্রকৃতির বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, পরিবেশ শিক্ষা প্রভৃতি বিষয় শিশু পাঠ করে
তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও জ্ঞানমূলক শক্তির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে।

(গ) শৃঙ্খলাবোধের বিকাশ : গাছের পাতা ঝরার
সাধারণ উপসর্গ থেকে শুরু করে দিন-রাত্রির পরিবর্তন, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত ইত্যাদি
ঋতুর আবর্তন প্রভৃতি ঘটনা একটি না একটি নিয়ম মেনে সংঘটিত হয়। আর প্রকৃতির এই নিয়মবদ্ধতা
শিশুর মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত করে।

(ঘ) নান্দনিক বিকাশ : প্রাকৃতিক পরিবেশে
অজস্র প্রাণময় গাছপালা, আকাশ, বাতাস শিশুর সুকুমার বৃত্তিগুলিকে ফুটন্ত ফুলের মতো
বর্ণময় করে তুলেছে। প্রকৃতি মানুষের সামনে তার এক নিজস্ব সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ তুলে
ধরেছে যা বিখ্যাত শিল্পীরা তাঁদের তুলির টানে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে চলেছেন।

(ঙ) সামাজিক বিকাশ : প্রকৃতির রাজ্যে
বসবাসকারী ইতর প্রাণীরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে, তাঁদের মধ্যে অপার স্নেহ, পারস্পরিক
সমবেদনা ও সহযোগিতা আছে। আর আছে আনন্দ, বেদনা, প্রতিহিংসা ইত্যাদির মতো সামাজিক প্রতিক্রিয়াগুলি।
প্রাকৃতিক পরিবেশের এই সজীব অংশ শিশুর-সামাজিক বিকাশের সহায়ক।

(চ) প্রাক্ষোভিক বিকাশ : প্রত্যেক মানুষ
প্রকৃতির মধ্যেই নিজেকে স্বাধীন ও মুক্ত ভাবে। এই মুক্ত পরিবেশেই মানুষ এবং প্রাণীর
সহাবস্থান ঘটে। মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে এই স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধন শিশুর প্রাক্ষোভিক
বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করে।

(ছ) সম্ভাবনার বিকাশ :  প্রতিটি শিশু বংশধারা সূত্রে প্রাপ্ত সুপ্ত সম্ভাবনা
গুলি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ শিক্ষার্থীর বংশধরার সূত্রে প্রাপ্ত
সম্ভাবনা গুলি সুষ্ঠ স্বাভাবিক বিকাশে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(জ)  শিখনের সহায়ক
:
অনুকূল
প্রাকৃতিক পরিবেশে বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো যেমন প্রশস্ত এবং আলো বাতাস যুক্ত, শ্রেণীকক্ষে
উপযুক্ত বসার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় শিক্ষোপকরণের সরবরাহ শিখনের পক্ষে সহায়ক। এছাড়া
শিক্ষার্থীদের উপযোগী পাঠাগার, রসায়নগার, খেলার মাঠ ইত্যাদি উত্তম শিখন এবং অভিজ্ঞতা
অর্জনের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশগত উপাদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(ঝ) মনোযোগ আকর্ষণে সহায়ক : নির্জন এবং মনোরম
প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সহজেই আকর্ষণ করা যায় যা শিক্ষা শিখন প্রক্রিয়ার
প্রাথমিক শর্ত।

 

 

সামাজিক পরিবেশ
(Social Environment) :

পরিবেশের যে অংশে
মানুষ জন্মায়, বড়ো হয় সেটি মূলত মনুষ্য সৃষ্ট সমাজ পরিবেশ। এই সামাজিক পরিবেশে যেমনি
পরিবারের সদস্য বাবা, মা, ভাই, বোন নিয়ে গঠিত অংশ যারা স্বাভাবিক নিয়ম নীতি পালনের
মধ্য দিয়ে সদস্যদের সক্রিয় করে তোলে, তেমনি ক্লাব, রাষ্ট্র, ধর্মীয় সংস্থা ইত্যাদি
যারা শিশুর সামাজিকীকরণ, সহাবস্থান, সহযোগিতামূলক মনোভাব গঠনে সহায়তা করে।

 

শিশুর বিকাশে সামাজিক
পরিবেশের ভূমিকা :

আধুনিক মনঃস্তত্ববিদ
ও শিক্ষাবিদগণ সমাজ পরিবেশকে শিশুর জীবন বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে
ব্যক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাদের অভিমত মানবশিশু জন্মের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত
অসহায় থাকে, পরিবারের পিতা-মাতা এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশকে সুনিশ্চিত
করার জন্য এবং জৈবিক অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সহযোগিতা, সমবেদনা, নেতৃত্ব-নির্দেশনা
প্রভৃতি দিকগুলি সুনিশ্চিত করে। এ প্রসঙ্গে সমাজ পরিবেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
উল্লেখ করা হল—

(ক) দৈহিক বিকাশ : গৃহ পরিবেশে পিতা-মাতা এবং বয়স্ক-ব্যক্তিরা
তার জৈবিক অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কঠোর অধ্যাবসায় ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় শিশুর
হাঁটা, দৌড়ানো, লাফানো, কোনো কিছুকে শক্ত মুঠিতে ধরা, খাদ্য নির্বাচন, পোষাক-পরিচ্ছদ
এবং নিরাপদ আশ্রয় দান-এর সঙ্গে সু-অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে। পরবর্তীকালে বিদ্যালয়,
ক্লাব প্রভৃতি শিশুর দৈহিক বিকাশকে সুনিশ্চিত করে।

(খ) মানসিক বিকাশ : শিশুর ভাষাগত বিকাশ,
উচ্চারণভঙ্গি, গণনা করা, বিভিন্ন সমাজবাঞ্ছিত আচরণ গড়ে তোলা, চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি,
স্মৃতিশক্তি, সৃজনশীলতা ও যুক্তিশীলতা প্রভৃতির বিকাশ ঘটানোর জন্য পরিবার, বিদ্যালয়,
ক্রীড়া সংস্থা, গণমাধ্যম এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

(গ) সামাজিক বিকাশ : জন্মগতভাবে মানুষ,
সামাজিক বা অসামাজিক কোনোটাই নয়। কিন্তু যেহেতু সমাজ পরিবেশে তার জন্ম, বৃদ্ধি ও মৃত্যু
তাই সামাজিক অনুশাসনগুলি শিশুকে মেনে চলতে হয়। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ সমবেদনা,
সহযোগিতা, নেতৃত্ব, সমমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক গুণগুলি আয়ত্ত করে এবং এর মাধ্যমেই সামাজিক
স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

(ঘ) প্রাঙ্কোভিক বিকাশ : জন্মের পর থেকেই
শিশু প্রাক্ষোভিক প্রতিক্রিয়া করতে শেখে। যেহেতু প্রক্ষোভ থেকে মানবশিশুকে পৃথক করা
যায় না তাই প্রক্ষোভের সংযত প্রকাশ সামাজিক দিক থেকে কাম্য। এই জন্য বিদ্যালয় প্রশাসন,
ধর্মীয় সংস্থা, বৃহত্তর রাষ্ট্র, পরিবার প্রভৃতি বিশেষভাবে এই আচরণগুলিকে প্রভাবিত
করে।

(ঙ) বৌদ্ধিক বিকাশ : সমাজ-পরিবেশের অন্তর্গত
বয়স্কব্যক্তিদের কাছ থেকে শিশু ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় সংক্রান্ত বহু
প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, সমাজে বসবাস করতে করতে শিশুরা সমাজ প্রশাসনের রীতিনীতি
সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয় এবং সে বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে যা বৌদ্ধিক বিকাশের
সহায়ক।

(চ) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ : শিশু বড়ো হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে সে ভালোমন্দ বোধ, ঔচিত্যও অনুচিত্য বোধ গড়ে ওঠে যা নৈতিক বিকাশের সহায়ক।
সমাজে-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, পরিবার প্রভৃতি শিশুর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশে সহায়তা
করে।

(ছ) শৃঙ্খলাবোধের বিকাশ : শিশুরা তাদের খেলার
সাথীদের নিয়ে দল গড়ে, আবার বয়স্করা বিশেষ সহমত গঠন করার জন্য দল গড়ে; অবসর বিনোদনের
জন্য দল গঠন করে; সমিতি, ক্লাব ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে
কিছু আচরণবিধি মেনে চলার প্রবণতা দেখা দেয়। এর ফলে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধের
বিকাশ হয়।


 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top