শিক্ষকের কাজ ও দায়িত্ব
(Function and Responsibilities of a Teacher)
প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী
শিক্ষকের একমাত্র কাজ ছিল বিদ্যা দান করা। শিক্ষক ছিলেন জ্ঞানের ভাণ্ডার, যার থেকে
তিনি ছাত্রদের জ্ঞান বিতরণ করতেন। আধুনিক শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন নয়,
পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ করা। তাই আজকের শিক্ষকের কর্মপরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। আজকের
শিক্ষকের কাজ কেবল শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ নয়। আজকের শিক্ষায় শিক্ষার্থী জীবনের বহু
বিচিত্র ক্ষেত্র থেকে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এজন্য শিক্ষার্থীর কাজে সহযোগী বন্ধুর
ন্যায় তাকে সাহায্য করতে হয়। তিনি শুধু জ্ঞানদাতা নন, তিনি বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক।
সপ্তদশ শতকে শিক্ষাবিদ
কমেনিয়াস বলেছিলেন—‘শিক্ষা হল শিশুর জ্ঞান পরিচালনা। যেভাবে মাছ সাঁতার শেখে, পাখি
উড়তে শেখে, প্রাণী দৌড়তে শেখে—সেভাবে শিক্ষাগ্রহণ করবে’। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পরিকল্পনার
উদ্যোক্তা ফ্রয়েবেল শিক্ষালয়কে বলেছিলেন—‘শিশু উদ্যান’, শিশুরা সেখানে চারাগাছ ও
শিক্ষক হলেন মালী। মাদাম মভেম্বরীও তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিকাকে বলেছেন, “পরিচালিকা”।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষার কাজের নানা দায়িত্ব বেড়ে গেলেও
শিক্ষালাভের দৈনন্দিন কাজে, পাঠদানে শিক্ষকের কাজ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষকের শিক্ষা
সংক্রান্ত দায়িত্বগুলি হল :
(১) পাঠদান বা শিক্ষাদান : শিক্ষাদান শিক্ষকের
প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। শিক্ষক বিষয়বস্তু সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হবেন ও সেইমত
নিজেকে তৈরি করবেন। ছাত্রদের মধ্যে প্রেষণা জাগ্রত করবেন, উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে
শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তু আত্তীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। প্রতিদিন গৃহকাজ
(Home task) দেখবেন, সংশোধন করবেন।
(২) পরিকল্পনা : উপযুক্ত ও যোগ্য শিক্ষক পূর্বেই তার
পাঠদান পরিকল্পনা করবেন। সপ্তাহে কতটা বিষয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের শেখাবেন এবং প্রতিদিনকার
শ্রেণিকক্ষের নির্ধারিত সময় কীভাবে ব্যয় করবেন তার পূর্ব-পরিকল্পনা করবেন।
(৩) সাংগঠনিক : বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র, পাঠক্রমের
পরিকল্পনা বিভাজন, শিক্ষার্থীদের শ্রেণি বিভাজন, সময় তালিকা, সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির
পরীক্ষাগার, গ্রন্থাগার ইত্যাদি বিষয়ে নানা সাংগঠনিক কাজের দায়িত্ব শিক্ষককে নিতে
হবে।
(৪) পঠন-পাঠন ও ক্রিয়াকর্মের তত্ত্বাবধান : বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের
পঠন-পাঠনে ও অন্যান্য কাজের তত্ত্বাবধায়ক হলেন শিক্ষক। তিনি শিক্ষার্থীদের গৃহকার্যের
প্রাত্যহিক অগ্রগতি তত্ত্বাবধান করবেন।
(৫) পথ প্রদর্শক ও সুপরিচালনা : শিক্ষক শুধু যে
শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধান বা Supervise করবেন তা নয়, শিক্ষকের কাজ হল শিক্ষার্থীর
পঠন-পাঠন কাজকর্মের জন্য পরিচালকের কাজ করা। সকল ছাত্র তো বটেই, এমনকী যারা অনগ্রসর,
তাদের অপসঙ্গতির দিকটায় বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
(৬) মূল্যায়ন : শিক্ষার্থীর পঠন-পাঠন অথবা শিক্ষার্থীর
পারদর্শিতা কতটা হয়েছে তা নিরূপণ করা বা পরিমাপ করা দরকার। তা না হলে ভবিষ্যতের পথে
এগনো যাবে না। তাছাড়াও শিক্ষকের জানা দরকার শিক্ষার্থীর ত্রুটি কোথায়? দুর্বলতা কোথায়?
এসবের জন্য পরীক্ষা, অভীক্ষা, মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
(৭) তথ্য রক্ষণাবেক্ষণ : শিক্ষার্থী সম্পর্কে
নানাধরনের তথ্য রাখা দরকার। ওই সকল তথ্য শিক্ষার্থীর
ভবিষ্যৎ পরিচালনা
ও পরিমাপ করার জন্য প্রয়োজন। শিক্ষক যত্ন করে ওই সকল তথ্য সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করবেন।
(৮) সুসম্পর্ক : শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজের অন্যান্য
দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার দায়িত্ব শিক্ষকের। তার সহকর্মী
ও প্রধানের সহিতও সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। এজন্য শিক্ষকের যথেষ্ট সামাজিক গুণাবলি
থাকা প্রয়োজন।
শিক্ষা প্রক্রিয়ার
আধুনিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকের কাজের দিগন্ত বহুলাংশে প্রসারিত হয়েছে। সে দিকে
লক্ষ্য রেখে শিক্ষকের কাজগুলি উল্লেখ করা হল :
(১) শিক্ষক হবেন নির্দেশক : শিক্ষকের মূল কাজ
হবে শিক্ষার্থীকে স্বাধীনভাবে শিখতে সাহায্য করা। শিক্ষার্থীরা আশা করে শিক্ষক উপযুক্ত
নির্দেশনা দানের মাধ্যমে বিষয়বস্তুর অর্থ, সমস্যার তাৎপর্য ও সমাধানে সহায়তা করবেন।
এ প্রসঙ্গে মার্স ও টেলার তাই বলেছেন—“Pupil expect the teacher to teacher.’ অর্থাৎ,
মানুষ আশা করে শিক্ষক নির্দেশনা দেবেন।
(২) প্রজ্জালক : শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানের আলো ফুটিয়ে
তোলার কাজটি শিক্ষকের। শিক্ষার্থীর মধ্যে আছে সম্ভাবনা, জ্বলে ওঠার প্রবণতা। শিক্ষকের
কাজ হল ওই ইন্ধনে প্রথম স্ফুলিঙ্গটির সৃষ্টি করা।
(৩) ব্যাখ্যা দেওয়া : শিক্ষার্থীর বিকাশের
জন্য কাম্য ও লব্ধ অভিজ্ঞতার সমস্যাগুলিকে ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব শিক্ষকের। শিক্ষার্থীর
চারপাশের পরিবেশের সবকিছু তার সামনে সংগতিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা না দিলে জ্ঞান, তত্ত্ব
ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে মেলবন্ধন ঘটবে না।
(৪) বৃত্তি পরিচালক : আগামী দিনে যোগ্য
নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হলে শিক্ষার্থীকে তার নিজ জীবিকা নির্বাহের দক্ষতা লাভ করতে
হবে। এই বৃত্তি নির্বাচনে শিক্ষকের এক বিরাট ভূমিকা আছে। শুধু বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপের
দায়িত্ব নয়, বৃত্তি পরিচালক হিসেবেও তার ভূমিকা রয়েছে।
(৫) মূল্যবোধ পরিবেশক : সমাজে যে সকল
মূল্যবোধ শ্রেয় ও কাম্য বলে বিবেচিত হয় সেগুলিকে শিক্ষার্থীর সামনে কার্যকরীভাবে
তুলে ধরা ও শাশ্বত, সর্বজনীন মূল্যবোধগুলি শিক্ষার্থীর জীবনে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকের।
শিক্ষার্থী যাতে মূল্যবোধগুলির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে অনুসরণ করে সেটা লক্ষ রাখার দায়িত্ব
শিক্ষকের।
(৬) পরিত্রাতা : নানা জটিল ও দ্বন্দ্বমূলক কারণে শিক্ষার্থীর
মনে মানসিক ও প্রাক্ষোভিক জটিলতা, হত’ গা, দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে ; স্বার্থ অভিযোজনে
ব্যর্থ হতে পারে। শিক্ষক পরামর্শ, নির্দেশদানের মাধ্যমে, সহানুভূতির মাধ্যমে সার্থক
অভিযোজনে তাকে সক্ষম করে গড়ে তুলবেন। শিক্ষক এখানে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ।
(৭) সংযোগকারী সেতু : সামাজিক ঐতিহ্য
পরিবহনের মধ্য দিয়ে সমাজের বিবর্তন ও নিরবিচ্ছিন্নতাকে বজায় রাখা দরকার। শিক্ষক অতীত
ও ভবিষ্যত ধারার মধ্যে ফাঁক পূরণ করে শিক্ষার্থী ও প্রচলিত সামাজিক অভিজ্ঞতার মধ্যে
সংযোগকারী ব্যক্তি হিসেবে কাজ করবেন।
(৮) সমাজনেতা হবেন : শিক্ষক নিজে যেমন
সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ হবেন, তেমনি শিক্ষার্থীদেরকেও সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ করবেন। সমাজ
গড়ার কাজে তার ভূমিকা অগ্রণী। শিক্ষকের নেতৃত্বেই শিক্ষার্থী সমাজ গঠনে এগিয়ে আসবে
ও সমাজের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র
পাঠ্যপুস্তকের ভিত্তিতে জ্ঞান বিতরণ করাই আধুনিককালে শিক্ষকের কাজ নয়, তার দায়িত্ব
আরও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছাত্রদের সমাজবদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই সূত্রে
বলা যায় যে, বিদ্যালয় একটা সামাজিক সংস্থা যা মাধ্যমিক গোষ্ঠীভুক্ত এবং যা একটি জটিল
সম্প্রদায়ভুক্ত সত্ত্বার অন্তর্গত সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং ব্যাখ্যার মাধ্যমে ছাত্রদের
সমাজবদ্ধ করে। আর ছাত্রদের সমাজবদ্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই দায়বদ্ধ। আবার
অন্যদিক থেকে বলা যায়, শিক্ষকের কর্মক্ষেত্র কেবলমাত্র শিক্ষালয়ের শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ
নয়, সমগ্র সমাজই তার কর্মক্ষেত্র। তিনি নিষ্ক্রিয় নন, তিনি শিক্ষার্থীদের জীবন পর্যবেক্ষণ
করবেন, সাহায্য করবেন, প্রভাবিত করবেন, এটাই তার কাছে প্রত্যাশিত।
- ‘শিক্ষা’ বা Education’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করো
- প্রাচীন মতে শিক্ষা কী?
- আধুনিক মতে শিক্ষা কী ?
- আধুনিক যুগের শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করো
- শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর সুসংহত বিকাশ-উক্তিটি আলোচনা করো
- শিক্ষার উদ্দেশ্য সংগতিবিধান বা অভিযোজন—উক্তিটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো
- শিক্ষার ব্যপক অর্থ বলতে কী বোঝায় | ব্যপক অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো
- সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা ও ব্যাপক অর্থে শিক্ষার পার্থক্য লেখ
- শিখনের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ।
- শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলি আলোচনা করো
- শিক্ষার লক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তা | শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করো
- শিক্ষার লক্ষ্য পরিবর্তনশীল কেন?
- শিক্ষার সমাজতান্তিক লক্ষ্য বলতে কি বোঝ | সমাজতান্তিক লক্ষ্যের বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি বা লক্ষ্যগুলি লেখ