সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণ তুলনামূলক আলোচনা কর।
সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘুরি ভারত ইতিহাসে দুই উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। এই দুই
তুর্কি মুসলমান একাধিক বার ভারত আক্রমণ করেছেন। তবে মামুদ ও ঘুড়ি ভারত আক্রমণের
উদ্দেশ্য ও সাফল্যের বিচারে সাদৃশ্য অপেক্ষা বৈসাদৃশ্য ছিল বেশি। দুজনেই ছিলেন দুই
যুগের মানুষ এবং তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় 150 বছর।
সুলতান মামুদ ছিলেন পারসিক নবজাগরণের যুগের মানুষ এবং স্বাভাবিকভাবেই একটা বিশেষ
আলোকপ্রাপ্ত মূল্যবোধ দ্বারা দীক্ষিত। অপরদিকে মহম্মদ ঘুরি ছিলেন সেই যুগের মানুষ
যে যুগে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কোন বালাই ছিল না। পণ্ডিতেরা এদের তুলনামূলক বিচার করে
নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
প্রথমতঃ– সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের মূল প্রেরণা ছিল এদেশে ধন সম্পদ লুণ্ঠন করা।
ভারতের সঞ্চিত ধনরত্নের প্রাচুর্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তিনি অভিযানে লিপ্ত হন।
তিনি সব অভিযানে সফল হয়েও এবং দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন ভারতবর্ষে তার পক্ষে সাম্রাজ্য
স্থাপনের সম্পূর্ণ অনুকূল পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও মা্মুদ এ দেশে স্থায়ী সাম্রাজ্য
স্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পক্ষান্তরে মহম্মদ ঘুরি এদেশে সম্পদে
প্রলুব্ধ হলেও তার মূল লক্ষ্য ছিল স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। তাই ঐতিহাসিকদের
কাছে মামুদ ছিলেন একজন বৃহৎ লুন্ঠঙ্কারী আর ঘুরি ছিলেন ভারতে তুর্কি সাম্রাজ্যের
প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ।
দ্বিতীয়তঃ- সমরকুশলী যোদ্ধা ও সমরবিজয়ী সেনাপতি হিসেবে সুলতান মামুদ,
মহম্মদ ঘুরির তুলনায় অনেকাংশ অগ্রাণী ছিলেন। সুলতান মামুদ মোট 17 বার ভারত আক্রমণ করে এবং তাঁর প্রতিটি অভিযান সফল হন। অপরপক্ষে
ঘুরি 1175-1206 খ্রিঃ পর্যন্ত ভারত অভিযানে “আনহিলয়ারা”
এবং “তরাইনের প্রথম যুদ্ধে” তিনি পরাজিত হয়।
তৃতীয়তঃ– সুলতান মামুদের সামরিক প্রতিভা থাকলেও প্রশাসনিক প্রতিভা ছিল খুবই কম। তিনি
মধ্য এশিয়ায় এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও তার স্থায়িত্ব ছিল না। অন্যদিকে
ঘুরি ব্যক্তিগত সাংগঠনিক প্রতিভা ও প্রশাসনিক উদ্ভাবনী শক্তির দ্বারা আপন বিজয়কে
স্থায়িত্ব দিতে পেরেছিল।
চতুর্থতঃ– ভারতের একজন নিষ্ঠুর সেনাপতি ও লুণ্ঠনকারী রূপে প্রভাবিত হলেও সুলতান মামুদ
বিবিধ গুনের অধিকারী ছিলেন। তিনি বিদ্ধান ব্যক্তিদের সমাদর করতেন। সেকালে বহু
জ্ঞানীগুনি ব্যক্তি মামুদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। তিনি গজনীতে একটি সমৃদ্ধ ও
সুসজ্জিত নগরীতে পরিণত করেন। তাঁর চেষ্টায় গজনীতে ইসলামিক
শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম ক্ষেত্রে পরিণত হয়। কিন্তু ঘুড়ির চরিত্রে
সংস্কৃতি প্রীতির ক্ষেত্রে এই প্রাবল্য ছিল না। রাজ্যজয় ছাড়া কোন কিছুই তার চেতনায়
ছিল না।
পঞ্চমতঃ- সুলতাম মামুদ ভারতে নির্মমভাবে বহু মঠ, মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করেছেন। যা
মহম্মদ ঘুরি করেননি। কেবলমাত্র বারাণসী ও আজমীর ছাড়া তিনি কোথাও এ ধরনের কাজে
লিপ্ত হন নি।
ভারত ইতিহাসের সুলতান মাহমুদ একজন ধর্মান্ধ নির্মম অত্যাচারে এবং লুণ্ঠনকারী
হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন আর ঘুরি একজন অসাধারণ রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিভা সম্পন্ন
ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।