বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস | পরিচয় পত্রিকা, কল্লোল, সবুজপত্র | Semester II

পরিচয় পত্রিকা প্রকাশকাল, লেখকগোষ্ঠী ও বৈশিষ্ট্য, কল্লোল : প্রকাশকাল, লেখকগোষ্ঠী ও বৈশিষ্ট্য। (১৯২৩), সবুজপত্র : প্রকাশকাল, লেখকগোষ্ঠী ও বৈশিষ্ট্য

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

১. পরিচয় পত্রিকা: প্রকাশকাল, লেখকগোষ্ঠী ও বৈশিষ্ট্য :

* ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যে এক নব আন্দোলনের স্রষ্টা পরিচয় পত্রিকাটি। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে, ইংরাজী ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে। সম্পাদক ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক স্বনামধন্য কবি ও প্রাবন্ধিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। বর্তমানে পত্রিকাটি অমিতাভ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

* লেখকগোষ্ঠী: এই পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, হীরেন্দ্রনাথ দূরে। চারুচন্দ্র দত্ত, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, ননী ভৌমিক প্রমুখ।

অবদান ও বৈশিষ্ট্য: 

* পরিচয় পত্রিকা প্রকাশের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মননশীল পাঠকের কাছে প্রাচ্য পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন তুলে ধরা ও প্রাচ্য- পাশ্চাত্য ভাবধারার সমন্বয় সাধন করা।

* সস্তা আবেগ ও জনমনোরঞ্জনের পরিবর্তে সাহিত্যক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদের সঞ্চার ঘটাতে চেয়েছিল ‘পরিচয়’।

* প্রগতিশীল সমাজ ভাবনা, প্রগতিপন্থী রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে গভীর মননধর্মী সাহিত্য আন্দোলনকে যুক্ত করার মধ্যেই ছিল পরিচয় পত্রিকার বিশেষত্ব ।

* পত্রিকার প্রকাশিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রভৃতি ছিল জীবন দৃষ্টির গভীরতা ও মৌলিকতায় উৎকৃষ্ট ।

* হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন, সঙ্গীত, শিল্প, অনুবাদসাহিত্য, রুশ বিপ্লব সম্পর্কিত রচনার সাথে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পর্যালোচনা করে নতুন এক সাহিত্য-আদর্শ সৃষ্টি করে ‘পরিচয়’।

* সমাজ ও রাষ্ট্রচেতনায় স্বাধীন চিন্তা ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পরিচয়-গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য।

* উপসংহার : বাঙালীকে নতুন পৃথিবী ও নতুন ভাবনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে “পরিচয়” পত্রিকা। বাংলা সাহিত্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে এর অবদান অসামান্য।

২. কল্লোল : প্রকাশকাল, লেখকগোষ্ঠী ও বৈশিষ্ট্য। (১৯২৩)

* ভূমিকা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা সাহিত্যে নবযুগের পথিকৃৎ হল কল্লোল পত্রিকা। প্রেম, সৌন্দর্য, সমাজ প্রকৃতি ক্ষেত্রে নবধারণার বিদ্রোহ ঘোষণা করে কবি দীনেশরঞ্জন দাস এবং গোকুল চন্দ্র নাগ-এর সম্পাদনায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ‘কল্লোল’ এর প্রথম প্রকাশ।

* প্রকাশকাল : ১৯২৩ থেকে ১৯২৯ এই সাত বছরের প্রচন্ড যুগতাড়না কল্লোল পত্রিকার প্রেক্ষাপট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতবাসীর সাহায্যের বিনিময়ে স্বরাজদানের আশ্বাস যুদ্ধশেষে মিথ্যায় পরিণত হল। পরিবর্তে এল মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন। তাছাড়া আর্থিক মন্দা, মূল্যবৃদ্ধি, অর্থসংকট, বেকারত্ব প্রভৃতি সমস্যায় ভারত তথা বাংলার যুবসমাজের মধ্যে যে বিপুল, নৈরাশ্য সঞ্চারিত হয়েছিল – কল্লোল সেই নৈরাশ্য পীড়িত যুবসমাজেরই প্রতিনিধি।

* লেখকগোষ্ঠী: যাঁদের প্রতিভার দীপ্তিতে কল্লোলের পৃষ্ঠা দীপ্তিময় হয়ে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, মনীন্দ্রলাল বসু, জগদীশ গুপ্ত, মনীশ ঘটক, বুদদের বসু, জীবনানদ দাশ, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় অন্যতম।

* রোমান্টিক ভাবালুতা নয়, বাস্তবের কঠিন রুক্ষ মাটিতেই পথচলা হল কল্লোল গোষ্ঠীর সাধনা।

* মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের তত্ত্বের প্রভাবে দেহাতীত প্রেমের ভাব কল্পনার পরিবর্তে দৈহিক কামনা-বাসনাকে স্বীকৃতি দান-ই কল্লোল যুগের প্রেমচেতনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

* রুশ, জার্মান, ফরাসী প্রভৃতি পাশ্চাত্য সাহিত্যের উগ্র বাস্তবতা সঞ্চারিত হয়েছিল এই যুগের লেখকদের মধ্যে।

* উচ্চবিত্ত ও সম্ভ্রান্ত সমাজের পরিবর্তে কৃষক, শ্রমিক, বস্তি ও ফুটপাতবাসী, গণিকাপল্লী প্রভৃতি নিচুতলার মানুষের স্থূল জীবনচিত্র ছিল এই যুগের সাহিত্যের বিষয়।

* সাম্যবাদও কমিউনিজমের স্পষ্ট প্রভাব এই যুগের আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য।

       এককথায় রবীন্দ্র বিরোধী মানসিকতা ও বিদ্রোহ-ই কল্লোলের লক্ষ্য। এবিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য – 

“যাকে কল্লোলযুগ বলা হয় তার প্রধান লক্ষণই হল বিদ্রোহ। আর সে বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্যই রবীন্দ্রনাথ” ।

৩. সবুজপত্র : প্রকাশকাল, লেখকগোষ্ঠী ও বৈশিষ্ট্য: ১৯১৪ (এক স্বতন্ত্র ধারার সূচনা)

* ভূমিকা: প্রকাশ-ই যদি সাহিত্য হয় তবে তা বৃহত্তর জন সমক্ষে প্রকাশের ক্ষেত্রে সাময়িক পত্রগুলির ভূমিকা অনন্যসাধারণ । বাংলা সাময়িক পত্রের  ইতিহাসে ‘সবুজপত্র’ একটি উল্লেখযোগ্য নাম – যার সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং মনস্বী যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী (বীর বল) ।

* প্রকাশকাল: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে, ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে চরম সংকটকাল। মানবসভ্যতার চরম বিপর্যয়কারী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, পরাধীনতার গ্লানি, শাসন শোষনে নিষ্পেষিত মানব আত্মার ক্রন্দন ও মুক্তির আকাঙ্খা যখন ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে- এমনই যুগ পরিবেশে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘সবুজপত্র’।

* লেখকগোষ্ঠী: বঙ্গ দর্শনের মতোই ‘সবুজপত্র’ কে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র লেখকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, কিরণ শংকর রায়, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ মনস্বী লেখকগণ।

∆ বৈশিষ্ট্যঃ

* যুক্তি, প্রসাদগুণ, দৃঢ় প্রকৃতিস্থতা, মার্জিত রসিকতা, পরিশীলিত নাগরিক রুচি ও সংস্কৃতিবোধ সঞ্চার করে সবুজপত্র সাহিত্য ক্ষেত্রে এক স্বতন্ত্র নবপর্যায়ের সূচনা করেছিল।

•  শুধু দেশ-কাল ও সমাজ চর্চার পরিবর্তে বিশ্বনাগরিকতা ও বুদ্ধির উদ্বোধন-ই ছিল সবুজপত্র লেখকগোষ্ঠীর লক্ষ্য। অর্থাৎ রক্ষণশীলতা, জাত্যাভিমান, ঐতিহ্যের অহমিকা, ন্যাকামি, জ্যাঠামি প্রকৃতি দেশজ সংকীর্ণতার পরিবর্তে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য-ইতিহাস চর্চার রসায়নাগার সবুজপত্র বিশুদ্ধ বিশ্বচিন্তার প্রেরণা সঞ্চার করেছিল।

* সবুজ পত্রে নির্মল বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের (wit) প্রকাশ ঘটেছিল।

* সবুজপত্র চলিত ভাষার একছত্র আধিপত্যের পক্ষে আন্দোলন করেছিল, তবে তা ছিল মার্জিত এবং পরিশীলিত।

* সবুজপত্র যে নব্য সাহিত্য আন্দোলন শুরু করেছিল “যৌবন শক্তি”-ই ছিল তার প্রাণ, তার চালিকাশক্তি।

বাংলা গানের ইতিহাস | একাদশ শ্রেণী 2nd সেমিস্টার |

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top