কৈবর্ত বিদ্রোহের বিবরণ দাও। বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করো। History Note। ClassGhar।

কৈবর্ত বিদ্রোহের বিবরণ দাও। বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করো। Give an account of the Kaivarta Rebellion. Discuss the nature of the rebellion.

কৈবর্ত বিদ্রোহ
কৈবর্ত বিদ্রোহ

কৈবর্ত বিদ্রোহ (Kaivarta Rebellion)

পাল রাজা তৃতীয় বিগ্রহ পালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল(1072-1073 খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। দ্বিতীয় মহীপাল এর শাসনকালে বাংলা কৈবর্ত বিদ্রোহের ঘটনা প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দ্বিতীয় মহীপাল এর আমলে বাংলায় শাসন শৃঙ্খলার যে অবনতি দেখা দিয়েছিল তা দূর করার মত যোগ্যতা তার ছিল না। এরমধ্যে অযোগ্য ও কুচক্রী দ্বিতীয় মহীপাল তাঁর দুই ভ্রাতা দ্বিতীয় সূরপাল ও রামপালকে কারারুদ্ধ করলে পাল সাম্রাজ্যের সংকট দেখা দেয়। এই অবস্থায় উত্তরবঙ্গে বরেন্দ্রভূমি সামন্ত রাজারা দিব্য বা দিব্যকের নেতৃত্বে পাল রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ “কৈবর্ত বিদ্রোহ” নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হয় এবং বিদ্রোহের নেতা দিব্য বরেন্দ্রভূমিতে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

উপাদানঃ– দ্বিতীয় মহিপাল এর পতন ও দিব্যের অভ্যুত্থান সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিত” গ্রন্থ। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এটি পাল বংশের প্রতি পক্ষপাতে দুষ্ট। এই গ্রন্থটি ছাড়াও কুমার পালের মন্ত্রী বৈদ্য দেবের “কামাউলি পট্ট”, মদন পালের “মানাহালি দানপত্র” এবং পূর্ববঙ্গের ভোজবর্বনের “বেলবদানপত্র” এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।

কৈবর্ত কারা– দ্বিতীয় মহীপাল এর আমলে উত্তরবঙ্গে কৈবর্ত সম্প্রদায় বলতে প্রকৃতপক্ষে কাদের বোঝানো হয়েছে তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। ডক্টর এসপি লাহিড়ী, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমূখ মনে করেন যে, কৈবর্তরা ছিল বাংলার কৃষিজীবী ও যুদ্ধপ্রিয় সম্প্রদায়। অপরদিকে ড. নীহাররঞ্জন রায়, ড. বিনয় চন্দ্র সেন ও সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কৈবর্ত বলতে মৎস্যজীবীর সম্প্রদায় কে নির্দেশ করেছেন।

কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণ

বিদ্রোহের কারণ:- দ্বিতীয় মহীপাল এর আমলে সংঘটিত কৈবর্ত বিদ্রোহের সঠিক কারণ সম্পর্কে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক আছে। বিভিন্ন পন্ডিত এই বিদ্রোহের পিছনে বিভিন্ন কারণে সন্ধান পেয়েছেন –

মহীপালের সিংহাসন দখলঃইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্র বলেন যে, বিগ্রহ পালের পর রামপাল ছিলেন সিংহাসনের যোগ্য ও সর্বসম্মত ব্যক্তি। কিন্তু বয়সের জোরে দ্বিতীয় মহীপাল রামপাল ও দ্বিতীয় শূরপাল কে কারারুদ্ধ করে সিংহাসন দখল করেন। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কৈবর্তরা বিদ্রোহ করেন।

রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাঃ-

ড. এস.পি লাহিড়ী মনে করেন যে, কৈবর্ত সম্প্রদায়ভুক্ত যশোদাস নামক জনৈক ব্যক্তি পাল রাজা রাজ্যপালের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তখন থেকেই কৈবর্তদের রাজনৈতিক উত্থান এর সূচনা সম্ভব হয়েছিল। এরপর থেকে কৈবর্তরা রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছিল।

ধর্মীয় কারণঃ-

ড. বিনয় চন্দ্র সেন বলেন যে, বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজারা একসময় নির্দেশ জারি করেন যে- মৎস সংগ্রহকারী বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে পারে না। এতে উত্তরবঙ্গের মৎস্যজীবীর সম্প্রদায়ভুক্ত কৈবর্তরা ক্ষুব্ধ হয় এবং মহীপালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তবে অনেকে এই তথ্য অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে পাল রাজারা ছিলেন ধর্ম বিষয়ে উদ।। তাই ধর্মীয় অত্যাচারের সম্ভাবনা ছিল না

রাজার অত্যাচারঃ-

পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে- কৈবর্তরা ছিল উত্তরবঙ্গের একটি শক্তিশালী ও যুদ্ধপ্রিয় সম্প্রদায়। দ্বিতীয় মহিপাল ছিলেন অত্যাচারী রাজা। মূলত তার অত্যাচারে জর্জরিত হয়েই তারা দিব্য এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন যে, “রাজশক্তি এমন কিছু অত্যাচার করেছিল যাহার বিরুদ্ধে অভিজাত সম্প্রদায় এবং প্রজাগণ বিদ্রোহী হইয়াছিল।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণঃ-

ড. উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, স্যার যদুনাথ সরকার এই বিদ্রোহের পিছনে গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ দেখেছেন। তাঁদের মতে- এই বিদ্র্থে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের দিব্য নেতৃত্ব দিলেও এটি শুধুমাত্র কৈবর্ত সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ ছিল না। কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে দিব্য এই বিদ্রোহ শুরু করেন। ড. মজুমদারের মতে, দিব্যর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এই বিদ্রোহের ইন্ধন যোগায় এবং রাজতন্ত্রের দুর্বলতা একে সাহায্য করে।

রামচরিত গ্রন্থ অনুসারেঃ

সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত এর কয়েকটি শ্লোকে দ্বিতীয় মহিপাল হত্যা এবং দিব্য-এর কাজ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। রামচরিত এর মতে, দ্বিতীয় মহীপাল ছিলেন স্বাধীনভাবে বিচার করার অদক্ষ। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন, এই সন্দেহে তিনি তার দুই ভ্রাতাকে কারাগারে বন্দী করেন। অত্যাচারী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে সামন্তরা সংঘবদ্ধভাবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। এই গ্রন্থে কৈবর্ত নায়ক দিব্যকে “দস্যু” এবং “উপধিব্রতী” বলা হয়েছে। উপাধিব্রতী কথার অর্থ- যিনি কর্তব্য পরায়ন ছদ্মবেশে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ করে। রামচরিত এই বিদ্রোহকে “অনিকম ধর্মবিপ্লব” বলা হয়েছে, যার অর্থ দিব্য বেআইনি ও বহির্ভূত বিপ্লব ঘটেছিল। তার আসল উদ্দ্যেশ্য ছিল নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করা।

কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রকৃতিঃ-

কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়েও ঐতিহাসিকরা একমত হতে পারেননি। এই বিদ্রোহকে শ্রেণী বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করলেও অন্যরা আবার একে সামাজিক বা রাজনৈতিক বিদ্রোহ হিসাবে দেখতে চেয়েছেন।

  1. সন্ধ্যাকর এর মতে, দিবে সিংহাসন অধিকার কাজ ছিল দস্যুদের মতো। তিনি ছিলেন উপধিব্রতী অর্থাৎ কর্তব্য পরায়ন ছদ্মবেশ ধারণকারী। তিনি অনিকম ধর্মবিপ্লব অর্থাৎ বেআইনি ও ধর্মবহির্ভুত বিপ্লব ঘটিয়ে ছিলেন। তাঁর আসল উদ্দ্যেশ্য ছিল নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করা। কিন্তু বাইরে তিনি জনগণকে রক্ষার জন্য ছদ্দ নেতৃত্ব দে। সম্মিলিত সামন্ত চক্রের দ্বারা এই বিদ্রোহ ঘটে।
  2. ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, আর পাঁচটা সাধারণ বিদ্রোহের মত বিদ্রোহ ছিল দুর্বল রাজার বিরুদ্ধে সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ। দিব্র কোন মহৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে জনগণকে দ্বিতীয় মহীপালের কুশাসন থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি।
  3.  ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল ও যদুনাথ সরকার প্রমুখ মনে করেন যে, এই বিদ্রোহে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের দিব্য নেতৃত্ব দিলেও এটি শুধুমাত্র কৈবর্ত সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ ছিল না, বাংলায় কেন্দ্রীয় রাজশক্তি্র দুর্বলতা ও রাজপরিবারের আন্তকলাহ উত্তরবঙ্গের সামন্তদের বিদ্রোহের শামিল হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছিল।

     বিদ্রোহের কালে দিব্য পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের এর বিরুদ্ধে অধিকাংশ সামন্তদের সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছিলেন। এই বিদ্রোহের ফলাফল সুদুরপ্রসারী ছিল না। সামন্তদের মধ্যে শীঘ্রই বিরোধ উপস্থিতি হয়। ফলে সামন্তদের একাংশের সাহায্য নিয়ে রামপাল সহজে সিংহাসন দখল করতে সক্ষম হন।।।

লিঙ্গ যুদ্ধের তাৎপর্য বা প্রভাব বা ফলাফল আলোচনা কর

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top