ভারতবর্ষের গল্পে গ্রাম্য জীবনের চিত্র
সাহিত্যের
আয়নায় আমরা দেখি সমাজের মুখচ্ছবি। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ছিলেন গ্রাম জীবনের সার্থক
রূপকার। তাই যে অদৃশ্য শিল্পী আমাদের জীবনের তাঁতে সাদা কালো রঙিন সুতো বুনে চলেছেন-
তার খবর তিনি দিয়েছেন “ভারতবর্ষ” সহ বিভিন্ন গল্পে।
ভারত
বর্ষ গল্পে যে গ্রামজীবনের ছবি আঁকা হয়েছে তার প্রত্যন্ত গ্রাম। নামহীন তাই তার বিস্তৃত
অনেক। গ্রামে না আছে
রাস্তাঘাট , না আছে বিদ্যুৎ। সবুজ ঝোপঝাড় বেষ্টিত কাঁচা রাস্তা গ্রামকে জুড়ে
দিয়েছে পিচ সড়কের সঙ্গে।
তবে
এ সড়কের বাঁকে গড়ে উঠেছে একটি ছোট্ট বাজার। যেখানে বিদ্যুৎ আছে। আছে দোকানপাট।হাস্কিং
মেশিন। পিছনে ইটভাটা। বাজারটি যেন সভ্যতার ছোট্ট উনুন। সেখানে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষদের
ঠান্ডা হয়ে যাওয়া প্রাণ গুলি একটু উষ্ণতার ছোঁয়া পায়।
গ্রামীণ
জীবন ছিল উত্থান-পতন, নিস্তরঙ্গ- একেবারেই একঘেয়ে। অবসর বিনোদনের কোন উপকরণ ছিলনা।
তাই কর্মহীন অবসর সময়টুকু কাটানোর একমাত্র উপায় হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিল চা দোকানের
আড্ডাকে। তাতে সময় কাটে আবার আনন্দের উপকরণ ও পাওয়া যায়। কখনও বোমবাইয়ের, কখনো
বা সংস্কৃতি জগত, কখনো রাজ্য তথা দেশের রাজনীতি, আবার কখনো বা সরা বাউড়ির মত কাউকে নিয়েপরচর্চাই আড্ডার বিষয় হিসেবে
জমজমাট হয়ে ওঠে।
এই
গ্রামীণ মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি। রোদ-বৃষ্টির সঙ্গে সমঝোতা করে তারা ফসল ফলায়।
ধানের মরশুম তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে
দীর্ঘায়িত করে। মুখে হাসি ফোটায়।
শিক্ষা
ও বিজ্ঞানের স্পর্শ বঞ্চিত এই মানুষগুলো সংস্কারাচ্ছন্ন, ঈশ্বরবিশ্বাসী। কিন্তু ডাওর
বা ফঁপি যখন তাদের জীবনধারণের অবলম্বন টুকু কেড়ে নিতে চায় তখন তারা অধৈর্য, ক্ষিপ্ত
হয়ে ওঠে। বলেই ফেলে -“মাথার ওপর আর কোন শালা নেই রে -কেউ নাই”।
শিক্ষাহীন
তাই ধর্মীয় কুসংস্কার তারা তাদের মর্মমূলে বাসা বেঁধে থাকে। তাই খয়া খর্বুটে বুড়ির নিঃসাড় দেহটিকে মৃতদেহ ভেবে সে কোন জাতের এবং
তার সৎকার কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় দাঙ্গার তপ্ত পরিবেশ। জীবিত মানুষকে ছেড়ে মৃত মানুষকে নিয়ে শুরু
করে জঘন্য নোংরামি।
তবে
দরিদ্র এই মানুষগুলোর নিত্যসঙ্গী। ফসলের মরসুমে ঋণের বোঝা বেড়ে চলে। তবুও হাসি ঠাট্টা
দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় তাদের দৈন্যকে।
গ্রামীণ
মানুষ বিশ্বাস করত প্রচলিত প্রবাদ প্রবচন।ডাক পুরুষের তেমনই একটি বচন কৃষক জীবনের অঙ্গীভূত ছিল।
“শনিতে সাত, মঙ্গলে পাঁচ, বুধে তিন-বাকি সব দিন দিন”।
গ্রামজীবন
এখনকার মতোই ছিল থানার নিয়ন্ত্রণে। তাবে থানা ছিল দূরবর্তী। তাই গ্রামীণ মানুষের নিরাপত্তা
ও শৃংখলার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল চৌকিদারের হাতে। সমস্যা সমাধানের জন্য মানুষ ছুটে
আসত চৌকিদারের কাছে। আর পেয়ে যেত সমাধানের ইঙ্গিত। বুড়ির মৃতদেহ নিয়ে সমস্যা তাই
“নদীতে ফেলে দিয়ে এসো!” এই সমাধানের নির্দেশ পায়।
সাম্প্রদায়িক
বিরোধ যখন চরমে ওঠে তখন এই বুড়ির মত দুর্লভ দু একটি চরিত্র জেগে ওঠে গ্রামজীবনের ধর্মীয় সংস্কারকে
শাসন করার জন্য। যারা জাতপাত মানে না। নিজের পরিচয় এর সূত্রটি খুঁজে পায় দেশমাতার
সঙ্গে নাড়ির যোগে।
এভাবেই
গল্পটিতে গ্রামীণ মানুষের জীবনের সহজ নিপুন এবং বাস্তব ছবি আঁকা হয়ে যায় গল্পকারের
লিখন রেখায়।
More Notes:- English