রাষ্ট্র
ও সরকারের পার্থক্য:
সুদূর
অতীতে একসময় রাষ্ট্র ও সরকারকে সমার্থক ভাবা হত। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ
লুই বলেছিলেন ‘আমিই রাষ্ট্র (I am the state’)। হ-এর লেভিয়াথান (Leviathan) গ্রন্থেও
রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্র ও
সরকারের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেগুলি হল-
1. প্রকৃতিগত পার্থক্য: রাষ্ট্র একটি তত্ত্বগত ধারণা। রাষ্ট্রকে চোখে দেখা
যায় না। রাষ্ট্রের রূপ বিমূর্ত। অন্যদিকে সরকার হল রাষ্ট্রের বাস্তব রূপ। তাই রাষ্ট্র
বলতে অনেকে সরকারকে বুঝে থাকেন। কিন্তু সরকার হল রাষ্ট্রীয় ধ্যানধারণার বাস্তব চেহারামাত্র।
2. আদর্শগত পার্থক্য: রাষ্ট্রের আদর্শকে বাস্তবায়িত করে সরকার। উইলােবির
মতে, সরকার হল এমন এক প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে কার্যকরী করে। এজন্য
সরকারের কোনো কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালিত হলে জনগণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারে,
গড়ে তুলতে পারে প্রতিরােধ। প্রসঙ্গত বলা যায়, সরকারের প্রতি বিরোধিতার মানে রাষ্ট্রদ্রোহিতা
নয়। সরকারবিরােধী ও রাষ্ট্রবিরােধী শব্দ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে।
3. সদস্যসংখ্যাগত পার্থক্য: রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড রয়েছে। সেই ভূখণ্ডের
সমস্ত অধিবাসী রাষ্ট্রে সদস্য। অন্যদিকে সরকার হল সমগ্র রাষ্ট্রের জনগণের একটি ক্ষুদ্র
অংশ নিয়ে গঠিত প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান। যেমন- আমাদের দেশের সমস্ত নাগরিককে নিয়ে
ভারত রাষ্ট্র গঠিত, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় নাগরিককে নিয়ে ভারত সরকার গঠিত হয়।
4. গঠনগত পার্থক্য : রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে গঠনগত দিক থেকে একটি মৌলিক
পার্থক্য রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়ােগ করে সরকার গঠন করে,
কিন্তু এইভাবে ভােটাধিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করা যায় না।
5. স্থায়িত্ব-সংক্রান্ত পার্থক্য: স্থায়িত্বের প্রশ্নে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে বিশেষ
পার্থক্য রয়েছে। সরকার ক্ষণস্থায়ী; আজ যে সরকার ক্ষমতায় আছে কাল সেই সরকার নাও থাকতে
পারে। কিন্তু রাষ্ট্র চিরস্থায়ী, তার একটা সুষ্ঠু ধারাবাহিকতা আছে।
6. বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য: রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও পার্থক্য
পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য চারটি, যথা—জনসমষ্টি,
নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। ছোটোবড়ো নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই
এগুলি বর্তমান। অন্যদিকে সরকারের ক্ষেত্রে এমন কোনো অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নেই। বিভিন্ন
রাষ্ট্রে সরকারের বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন। কোথাও গণতান্ত্রিক সরকার, কোথাও একনায়কতন্ত্রী,
কোথাও ফ্যাসিবাদী, আবার কোথাও বা সমাজতন্ত্রী সরকার। আবার সরকারের কাঠামো কোথাও এককেন্দ্রিক,
কোথাও যুক্তরাষ্ট্রীয়, কোথাও রাষ্ট্রপতিশাসিত অথবা সংসদীয় প্রকৃতির হতে পারে।
7. সার্বভৌম ক্ষমতা-সংক্রান্ত পার্থক্য: সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃত অধিকারী হল রাষ্ট্র, সরকার
নয়। রাষ্ট্রের প্রতিনিধিস্বরূপ সরকার এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভােগ ও প্রয়ােগ করে মাত্র।
8. অস্তিত্ব-সংক্রান্ত পার্থক্য: অধ্যাপক গার্নার জীবদেহের সঙ্গে রাষ্ট্রের তুলনা করে
বলেছেন সরকার হল রাষ্ট্রের মস্তিষ্কস্বরূপ। জীবদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মস্তিষ্কের যেমন
কোনো গুরুত্ব থাকে না, তেমন রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সরকারেরও কোনো অস্তিত্ব থাকে
না।
9. প্রতিষ্ঠান ও পরিচালকগত পার্থক্য: অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রকে একটি যৌথ মূলধনী কারবারের
সঙ্গে তুলনা করেছেন, যার পরিচালক হল সরকার। কাজেই পরিচালকমণ্ডলী যেমন একটি যৌথ কারবারের
অংশমাত্র, তেমন সরকারও রাষ্ট্রের একটি অংশমাত্র। এদিক থেকে দেখলে সরকার কখনও রাষ্ট্রের
সমার্থক হতে পারে না।
উপসংহার: উপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, রাষ্ট্র
ও সরকার কখনােই এক নয়, উভয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। বস্তুত, রাষ্ট্র হল
একটি তত্ত্বগত ধারণা। রাষ্ট্রের তত্ত্বগত ধারণার বাস্তব প্রতিনিধি হল সরকার।