পাঠক্রম রচনা নীতিগুলি আলোচনা কর | একটি আদর্শ পাঠক্রম গঠনের ক্ষেত্রে কি কি নীতি অনুসরণ করা উচিত?

 পাঠক্রম রচনা নীতি

পাঠক্রম গঠনের ক্ষেত্রে
মূল বিচার্য বিষয়গুলি আলোচনা কর। 

অথবা 

একটি আদর্শ পাঠক্রম গঠনের ক্ষেত্রে কি কি নীতি
অনুসরণ করা উচিত?


পাঠক্রম রচনার নীতিসমূহ
(Principles of Curriculum Construction) :

বিভিন্ন শিক্ষা দার্শনিকের
মতামতের ওপর ভিত্তি করে পাঠক্রম রচনার ক্ষেত্রে তিনটি নীতি অবলম্বিত হয়। এই তিনপ্রকার
নীতি হল— (১) পাঠক্রম বিষয়বস্তু নির্বাচন নীতি, (২) পাঠক্রমের উপাদান বিন্যাস  নীতি, (৩) পাঠক্রমের ক্রিয়াগত নীতি। এগুলির নিম্নে
আলোচিত হল—

 


(১) পাঠক্রমে বিষয়বস্তু
নির্বাচন নীতি
:

     শিক্ষাবিদরা বিভিন্ন সময়ে পাঠক্রমের বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে
কয়েকটি নীতির উল্লেখ করেছেন।

(ক) উদ্দেশ্য কেন্দ্রিকতার নীতি : এই নীতি অনুযায়ী
পাঠক্রমের উপাদান—বিষয়, কর্ম ও অভিজ্ঞতা যা শিক্ষার মূল লক্ষ্যের সহায়ক। তাই শিক্ষার
লক্ষ্য ও বিষয়ের উদ্দেশ্যগুলি বিশ্লেষণ করে পাঠক্রমের বিষয় নির্বাচন করা দরকার। যেমন—শিক্ষার
লক্ষ্য যদি হয় ব্যক্তিগত উৎকর্ষ সাধন তাহলে পাঠক্রমে শরীরচর্চা, বৌদ্ধিক বিকাশ, অনুসন্ধিৎসা,
প্রবণতা, স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে জোর দেওয়া প্রয়োজন।

(খ) শিশু কেন্দ্রিকতার নীতি : আধুনিক শিক্ষা
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা। শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটানো। তাই শিশুর
চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা, ক্ষমতা, প্রেষণা ইত্যাদির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠক্রমে বিষয়
ও পাঠ প্রস্তুত করা প্রয়োজন।

(গ) সমাজকেন্দ্রিকতার নীতি : শিক্ষার মধ্য
দিয়েই সমাজ তার চাহিদা, আশা-প্রত্যাশা পূরণ করে, পারস্পরিক সম্প্রীতি রক্ষা করে, আইন-শৃঙ্খলা
বজায় রাখে এবং উৎপাদন ও উন্নয়নের ধারণা অব্যাহত রাখে। তাই পাঠক্রমের বিষয় নির্বাচনের
ক্ষেত্রে সামাজিক চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।

(ঘ) সংরক্ষণের নীতি : পাঠক্রমের মাধ্যমেই
অতীত অভিজ্ঞতার সংরক্ষণ ও তার সঞ্চালন সম্ভব। শিক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা সামাজিক রীতি-নীতি
ও মূল্যবোধকে ধরে রাখতে চাই। এর জন্য পাঠক্র মানবজাতির পূর্ণ অভিজ্ঞতাগুলি সঠিকভাবে
প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। এই অভিজ্ঞতা যদি পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারি, তাহলে
ওইসব মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।

(ঙ) অগ্রমুখীতার নীতি : পাঠক্রমের বিষয়
নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে তা ব্যক্তি ও সমাজের
অগ্রগতির সহায়ক হবে। পাঠক্রমের বিষয় নির্বাচনের সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, আর্থসামাজিক
পরিবর্তন, বিশ্বায়নের গতিমুখ, তথ্য ও প্রযুক্তি ইত্যাদির কথা মনে রেখে পাঠক্রমের প্রয়োজনমাফিক
বিষয় ও উন্নয়নের নীতি সম্পর্কিত বিষয়বস্তু সংযুক্তিতে নজর দেওয়া হয়।

(চ) সৃজনাত্মক নীতি : শিক্ষার উদ্দেশ্য
হল শিশুর অন্তনির্হিত সম্ভাবনার বিকাশে সহায়তা করা। তাই পাঠক্রমে বিষয়বস্তু এমনভাবে
নির্বাচিত হবে যার মধ্য দিয়ে শিশুর সৃজনীপ্রতিভা ও অনুসন্ধিৎসা বিকাশে সহায়ক হয়।
শিক্ষাবিদ রেমন্ট (Raymont) এই নীতির গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, সৃজনাত্মক নীতিটি হল
পাঠক্রমের মধ্যে এমন সব অভিজ্ঞতা সন্নিবেশিত হবে যা শিশুর চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি,
সৃজনী প্রতিভার বিকাশে (development of creativity) সহায়ক হয়।

(ছ) কর্মকেন্দ্ৰিক নীতি : শিশুরা সব সময়
সক্রিয়। এই সক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে পাঠক্রম এমনভাবে রচিত হবে যেখানে শিক্ষার্থীর,
চাহিদা, ক্ষমতা, জীবিকার সুযোগ ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৃত্তিগুলি নির্ধারিত হয়।
বৃত্তি বা কর্মের তাড়নায় শিশু যে জ্ঞান অর্জন করে তাই অভিজ্ঞতার উৎস। এই প্রসঙ্গে
জন ডিউই বলেছেন—“জীবন হল কর্মের উপজাত ফল এবং শিক্ষা জন্ম নেয় এইসব কর্মের মধ্যেই।”

 

(২) পাঠক্রমের উপাদান
বিন্যাস নীতি : 

    পাঠক্রমে বিষয়বস্তু বিচ্ছিন্নভাবে না রেখে সুনির্দিষ্টভাবে করা বিন্যাস
প্রয়োজন। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদরা দুটি নীতির কথা বলেছেন। এগুলি হল—

(ক) সমন্বয়ের নীতি : পাঠক্রম রচনার
সময় শিক্ষার্থীর, বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক প্রত্যাশার মধ্যে সমন্বয়সাধন করা দরকার। পাঠক্রমের
মধ্যে বিষয়গুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে না রেখে বিভিন্ন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ধারণাগুলির মধ্যে
যতটা সম্ভব সমন্বয়সাধন করে পাঠক্রম রচনা করা প্রয়োজন। যেমন—জীবনবিজ্ঞানের (Life
science) ক্ষেত্রে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ও শারীরবিদ্যার বিষয়কে একত্রিত করে
একটি সমন্বয়িত বিষয়ে পরিণত করা হয়।

(খ) ক্রমবিন্যাসের নীতি : পাঠক্রম নির্ধারণের
সময় ক্রমবিন্যাসের নীতিটি অনুসরণ করা খুবই প্রয়োজন। কেননা পাঠক্রমের অন্তর্গত বিভিন্ন
বিষয়বস্তু বা অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের স্তর অনুযায়ী নির্দিষ্ট ক্রমে
বিন্যস্ত করা উচিত। এ ব্যাপারে স্কিনার ও থর্নডাইক পাঠক্রমের বিষয়বস্তু নির্ধারণের
ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পরিনমনের মান, অর্থবহ উপলব্ধির সংগঠন ও সংগতির ওপর জোর দিতে বলেছেন।

 

(৩) পাঠক্রমের ক্রিয়াগত
নীতি : 

    কোনো পাঠক্রমের সাফল্য নির্ভর করে ব্যবহারিক উপযোগিতা ও প্রায়োগিক কৌশলের ওপর।
এই ব্যাপারে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (U. G. C.) এন. সি. ই.
আর. টি (N. C.E. R. T.) ও বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন দুটি নীতির কথা বলেছেন—

(ক) সক্রিয়তার নীতি : আধুনিক শিক্ষার
পাঠক্রম রচনা করার সময় সক্রিয়তার নীতিটির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি। এর জন্য
বিভিন্ন ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজ, সৃজনাত্মক কাজ, খেলাধুলা, বিভিন্ন ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান
এবং পরীক্ষাগারে হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে এই সক্রিয়তাকে বাস্তব রূপ দেওয়া যায়।

(খ) নমনীয়তার নীতি : পাঠক্রমকে নমনীয়
করে তুলতে গেলে শিক্ষার্থীর চাহিদা, সামাজিক চাহিদা, মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদির সঙ্গে
ভারসাম্য রেখে পাঠক্রমের পুনর্বিন্যাস, সংযোজন ও পরিমার্জন হওয়া প্রয়োজন। পাঠক্রমের
মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যৌথ উদ্যোগে প্রতিনিয়ত পঠন-পাঠনে
নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যোগ করা নমনীয়তার আর একটি শর্ত।


 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top