অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পরিবারের ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো |

সমাজের
প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান হল পরিবার। পরিবার হল সেই সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান যা পৃথিবীর সমস্ত
সমাজে দেখা যায়। সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গৃহ বা পরিবারের নানারকম দায়িত্ব
রয়েছে। পরিবারের মধ্যেই শিশু জন্মলাভ করে, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে
প্রথম পরিচিত হয় এবং সমাজজীবন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ লাভ করে। গৃহ পরিবেশেই
শিশু বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক আচরণ শেখে, যেমন—কথা বলা, হাঁটা, দৌড়ানো, জামা-কাপড়
পরা ইত্যাদি। তাই পরিবারের দায়িত্ব হবে, শিশু যাতে যথাযথভাবে বিভিন্ন অভ্যাস আয়ত্ত
করতে পারে, সহানুভূতির সঙ্গে অন্যের সঙ্গে মিশতে পারে সে ব্যাপারে যত্নবান হওয়া।

 



শিশুর
শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা (Role of Family in Child’s Education)

আবহমান
কাল ধরে পরিবার অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে নানারকম ভূমিকা পালন করে 
আসছে।
এর মধ্যে কতগুলি সাধারণ দায়িত্ব ও কতকগুলি শিক্ষামূলক দায়িত্ব। নীচে পরিবারের সাধারণ
দায়িত্ব ও শিক্ষামূলকদায়িত্বগুলি উল্লেখ করা হল—

 

পরিবারের
সাধারণ কার্যাবলী :

 

(১) পরিবারের জৈবিক কাজ (Biological function) : সমগ্র পৃথিবীতে
পরিবারগুলি সমাজ বাঞ্ছিত পথে মানুষের জৈবিক প্রবৃত্তি ও চাহিদাগুলিকে পরিতৃপ্ত করে।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে পরিবারগুলি মানুষের জৈবিক চাহিদাগুলি পূরণ করে বংশগতির
ধারা তথা সমাজ প্রবাহকে সচল রাখতে সহায়তা করে।

(২) নিরাপত্তা রক্ষার কাজ (Protective function) : কেবলমাত্র সন্তানের
জন্মদান নয়, মানব শিশু দীর্ঘায়িত শৈশব ও তার নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেয় পরিবারের মধ্যে।
শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত ব্যক্তির নিরাপদ আশ্রয় তথা জীবনধারণের সবচেয়ে বিশ্বস্ত
প্রতিষ্ঠান হল পরিবার। কারণ পরিবারের মধ্যেই ব্যক্তি তার আহার, বাসস্থান ও পরিধানের
মতো মৌলিক প্রয়োজনের উপকরণগুলি পেয়ে থাকে, যা তার জৈবিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে
অত্যন্ত জরুরী।

(৩) অর্থনৈতিক কাজ (Economical function) : প্রাচীনকাল থেকেই
পরিবারগুলি দুই রকম উপায়ে অর্থনৈতিক প্রবাহকে গতিশীল রেখেছে—(১) কিছু ভোগ্যপণ্য উৎপাদন
করে (যেমন, কৃষিজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য প্রভৃতি), (২) পরিষেবার মাধ্যমে (যেমন,
বিভিন্ন বৃত্তি ও পেশার সঙ্গে যুক্ত পরিষেবা)।

(৪) সংরক্ষণমূলক কাজ (Preservative function) : পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে
স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সংরক্ষণ করে। শুধু তাই নয় সামাজিক অস্তিত্ব ও স্থয়িত্ব
রক্ষার্থে প্রতিটি সমাজকে তার ঐতিহ্যের ভাণ্ডারটি সংরক্ষণ করতে হয়। আর পরিবার যদি
শিশুকে তার সমাজের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত না করে তাহলে দেখা যায় বহু ক্ষেত্রেই শিশু
তার সমাজ জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে।

(৫) সঞ্চালনমূলক কাজ (Transmission function) : শিশুর সামাজিকীকরণ
বলতে বোঝায়, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিশু সমাজের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি,
লোকাচার, বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন, মূল্যবোধ ইত্যাদি আয়ত্ত করে। শিশুর এই সামাজিকীকরণে
পরিবারের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

(৬) মনোবৈজ্ঞানিক কাজ (Psychological function) : পরিবার প্রাচীনকাল
থেকে মানুষের সর্বপ্রকার সুকুমার বৃত্তিগুলির (যেমন—স্নেহ, মায়া, মমতা, প্রেম, প্রীতি,
সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি) পরিতৃপ্তিতে সহায়তা করে আসছে। শিশুর মধ্যে এই কোমল বৃত্তিগুলির
উন্মেষ ও পরিতৃপ্তি না ঘটলে তার দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত

 

পরিবারের শিক্ষামূলক
ভূমিকা :


(১) আচার-আচরণের শিক্ষা (Behaviour as Education) : পরিবারের মধ্যে
ধীরে ধীরে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু তার পিতামাতা ও বয়স্কদের আচরণ দেখে প্রভাবিত
হয়। এর ফলে শিশু একেবারে শৈশব অবস্থা থেকেই অনুকরণের মাধ্যমে প্রাথমিক আচরণগুলি আয়ত্ত
করে।

(২) অভ্যাস গঠনের শিক্ষা (Education for habit
formation)
: অভ্যাস হল এক ধরনের অর্জিত জৈব মানসিক প্রবণতা, যা বার বার অনুশীলনের
মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করে। পরিবারের মধ্যে পিতামাতা বা বয়স্কদের সহচর্যে শিশুর মধ্যে
কতকগুলি অতি প্রয়োজনীয় সু-অভ্যাস গড়ে ওঠে।

(৩) সামাজিক বিকাশ (Social development) : আধুনিক শিক্ষার একটি
প্রধান উদ্দেশ্য হল শিশুর মধ্যে সমাজ-চেতনা জাগ্রত করা ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করা।
পরিবারের মধ্যে থেকেই শিশু সমবেদনা, সহযোগিতা, সৌজন্যবোধ, সহনশীলতা ইত্যাদির মতো বহু
সামাজিক গুণ অর্জন করে।

(৪) প্রাক্ষোভিক বিকাশ (Emotional development) : আধুনিক শিক্ষার
একটি উদ্দেশ্য হল শিশুর প্রাক্ষোভিক বিকাশে সহায়তা করা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেবলমাত্র
সামাজিক মিথস্ক্রিয়াই সাধিত হয় না, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একটি গভীর প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার
সম্পর্ক থাকে, যা শিশুকে সংযত প্রাক্ষোভিক আচরণ প্রকাশ করতে শেখায়।

(৫) বৃত্তি শিক্ষা (Vocational Education) : প্রাচীনকাল থেকে
পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে পারিবারিক বৃত্তিগুলির প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। এক প্রজন্ম থেকে
পরবর্তী প্রজন্মে বৃত্তিমূলক দক্ষতা সঞ্চালিত হয়ে এক একটি পারিবারিক বৃত্তির (বাবা
ডাক্তার হলে ছেলেও ডাক্তার হয়) প্রবাহ গতিশীল থাকে।

(৬) বৌদ্ধিক বিকাশমূলক কাজ (Function of Intellectual
development) :
পরিবারের মধ্য থেকেই শিশুর মধ্যে বাঞ্ছিত বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে।
শিশুর চিন্তা, কল্পনা, সৃজনশীলতা, আগ্রহ, মনোভাব, প্রত্যক্ষণ, পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি বৌদ্ধিক
ক্ষমতাগুলির উন্মেষ ঘটে পরিবারের মধ্যে। আবার শিশুর বুদ্ধি (Intelligence), বাচনিক
শক্তি প্রভৃতিরও বিকাশ হয় পরিবারের মধ্যে।

(৭) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ (Moral & Spiritual
development) :
পরিবারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শিশুর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক
বিকাশে সহায়তা করা। প্রাচীন কাল থেকেই পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের কাছ থেকে নিন্দা,
প্রশংসা, ভালোবাসা, শাস্তি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের শিক্ষা শিশুরা থাকে, যার দ্বারা
শিশুদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ হয়।

 

(৮) সংস্কৃতির শিক্ষা : পরিবার শিশুর সাংস্কৃতিক
চেতনার বিকাশে সহায়তা করে। পরিবার শিশুর মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক গুণাবলীর বিকাশ
ঘটায়। ফলে শিশুর মধ্যে সুস্থ সংস্কৃতি বোধ জাগ্রত হয়।

(৯) জ্ঞান অর্জনের শিক্ষা : পরিবার শিশুকে
বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করে। জ্ঞান অর্জনের শিক্ষা, তাই প্রকৃতপক্ষে পরিবারেই
শুরু হয়।

(১০) মূল্যবোধের শিক্ষা : শিশুর মধ্যে মূল্যবোধ
গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার পরিবার বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পারিবারিক জীবনে বিভিন্ন কাজ
ও আচার-আচরণের মধ্যে দিয়েই শিশুর মধ্যে মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।

 

শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিবারের সীমাবদ্ধতা (Limitation of Family) :

 

শিক্ষার
সার্বিক প্রসারের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বিশেষ করে আমাদের মতো
দেশে যেখানে বেশির ভাগ মানুষ অশিক্ষিত সেখানে গৃহ-পরিবেশ থেকে আমরা বেশিরভাগ সময়ে
ভালো ফল আশা করতে পারি না। তাই পরিবার বা গৃহ যতই শিশুর শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করুক না কেন, আধুনিক পরিবারগুলির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন—

 

(১) শিক্ষার অপ্রতুলতা : আধুনিক জটিল জীবনযাত্রায়
সাবেকী যৌথ পরিবারগুলি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ক্রমে নিউক্লিয়ার পরিবার বা কেন্দ্রায়িত
পরিবারে পরিণত হচ্ছে। পরিবারের এই সাংগঠনিক পরিবর্তনের ফলে শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব
পালনের ক্ষেত্রে নানা অসংগতি দেখা দিচ্ছে। পরিবার শিশুকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করতে
পারছে না।

(২) নিরাপত্তার অভাব : আধুনিক জটিল সমাজ
জীবনে পরিবারের, বিশেষ করে পরিবারের পিতা-মাতার সম্পর্কের মধ্যেও ফাটল দেখা দিয়েছে।
বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা ডিভোর্স-এর সংখ্যা

দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায়
শিশুর নিরাপত্তার প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে।

(৩) অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি : বর্তমান পরিস্থিতির
তাগিদে জীবিকা অর্জনের জন্য পরিবারের পিতা-মাতাকে বাড়ির বাইরে অনেকটা সময় থাকতে হয়।
ফলে পরিবারে শিশুর নিঃসঙ্গতা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এই নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পাওয়ার
জন্য শিশু বিভিন্ন দলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছে, যেগুলি তার কাছে ভালোমন্দ বিচারের
ঊর্ধ্বে। তাই সমাজে শিশুর অপরাধ প্রবণতা (Juvenile delinquency) বেড়ে চলেছে।

(৪) পিতামাতার সীমাহীন আশা-আকাঙ্ক্ষা : আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার
যুগে পরিবারগুলি নিউক্লিয়ার বা কেন্দ্রায়িত হয়ে যাওয়ায় পারিবারিক বন্ধন অনেক শিথিল
হয়ে পড়েছে এবং শিশুর নিঃসঙ্গতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবারের একটি বা দুটি
শিশুর ওপর এসে পড়ছে পিতা-মাতার সীমাহীন আশা-আকাঙ্ক্ষার চাপ যা শিশুকে স্বার্থপর, আবেগহীন,
যন্ত্র মানবে পরিণত করছে।

(৫) নতুন চাহিদার অতৃপ্তি : আধুনিক পরিবর্তনশীল
সমাজে শিশুর মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে নতুন নতুন চাহিদা, যা পরিবারের পিতা-মাতা পূরণ করতে
পারছে না। ফলে শিশুর মধ্যে চাহিদা পরিপূর্ণ হচ্ছে না।

(৬) নিরক্ষরতাজনিত সমস্যা : আর্থিক বা অন্য
বিভিন্ন কারণে আজও আমাদের দেশে বহু পরিবার শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। নিরক্ষরতা সমস্যাটি
পরিবারের শিক্ষামূলক কাজের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সীমাবদ্ধতা।

(৭)  শিক্ষার বহুমুখীতা
:
  আধুনিক যুগে শিক্ষায় এত বৈচিত্র এসেছে যে কোন পরিবারের
পক্ষেই এত ধরনের শিক্ষা  শিশুদের দেওয়া সম্ভব
নয়।  পরিবার যতই শিক্ষিত হোক না কেন  শিশুকে সব ধরনের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা  বা ধারণা শিক্ষা দিতে পারেনা।  শিক্ষার বৈচিত্র বা বহুমুখী তার পরিবারের শিক্ষা
মূলক ভূমিকা ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সীম।

সবশেষে
একথা বলা প্রয়োজন যে, শিশুর শিক্ষা পূরণের ক্ষেত্রে ও সুষম বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবারের 
যতই
সীমাবদ্ধতা থাকুক না কেন, শিশুর সঙ্গতিবিধান ও সুষ্ঠু বিকাশ সাধন ঘটে পরিবারের মধ্য
থেকেই। কারণ শিশু জন্মায় পরিবারে এবং আস্তে আস্তে সে বড়ো হয়ে ওঠে পরিবারের মধ্যেই।
তাই গৃহ পরিবেশের গুরুত্ব শিশুর শিক্ষায় সবসময়েই স্বীকার্য।


 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top