সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির
শিক্ষামূলক গুরুপ্ত বা তাৎপর্য বা উপযোগিতা
সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির
তাৎপর্য (Significance of Co-curricular Activities):
আধুনিক শিক্ষাতত্ত্বের
ধারণা অনুযায়ী সহ-পাঠক্রম হল বিষয়ের সজীব ও সক্রিয় অংশ। বিদ্যালয়ে নির্ধারিত জ্ঞানমুখী
পাঠদানের সঙ্গে সঙ্গে সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমকে শুধু উৎসাহিত না করে অত্যাবশ্যক বিষয়রূপে
স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির ভিন্ন ভিন্ন উপযোগিতা
বিশ্লেষণ করেছেন।
(১) শিক্ষার্থীর চাহিদার পরিতৃপ্তি : প্রত্যেক শিশুই
জন্মসূত্রে কিছু প্রবণতা ও সামর্থ্যের অধিকারী। আধুনিক শিক্ষার কাজ হল শিক্ষার্থীর
ওই সমস্ত প্রবণতাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীর যথাযথ বিকাশ
ঘটানো। এই প্রবণতা
বিকাশের দুটি দিক আছে। প্রথমত, শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত এই প্রবণতাগুলির প্রকৃতি সঠিকভাবে
নির্ণয়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীর প্রবণতা ও চাহিদা অনুযায়ী সেগুলির চর্চার সুযোগ।
সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি একই সঙ্গে এই দুটি দায়িত্ব পালন করে।
(২) বিদ্যালয় পাঠ্যসূচীর পরিপূরক : সাহিত্য, অঙ্ক,
ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি স্কুলপাঠ্য বিষয়গুলির পরিপূরক সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি
হল অভিনয়, শিক্ষামূলক ভ্রমণ, মিউজিয়াম সংগঠন, ভাষাগত জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য পত্রপত্রিকা
প্রকাশ, আলোচনাচক্র, বিতর্কসভা প্রভৃতি।
(2) শারীরিক স্বাস্থ্যগঠন : সাধারণ কথায়
বলা হয় ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’ বা ‘স্বাস্থ্য সকল সুখের ভিত্তি’। সুতরাং, দৈহিক কার্যাবলি
শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ এবং শারীরশিক্ষার গুরুত্ব সর্বজন স্বীকৃত। এই প্রসঙ্গে স্বামী
বিবেকানন্দ বলতেন, “আজকের ভারতে প্রয়োজন ভাগবত গীতা নয়— —ফুটবলের মাঠ”।
(৪) প্রাক্ষোভিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণ : শিক্ষার্থীদের
যদি সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির মধ্যে সর্বদা নিয়োজিত রাখা যায় তাহলে তাদের মধ্যে উদ্যম,
উৎসাহ, প্রেরণা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি হিংসা-দ্বেষ এবং অন্যান্য অবাঞ্ছনীয় প্রবৃত্তি
নিয়ন্ত্রিত হবে, শিক্ষার্থীর মানসিক স্তরে ভাবসংহতি স্থাপিত হবে।
(৫) শিক্ষার্থীর সামাজিক সত্ত্বার বিকাশ : শিক্ষার একটি
প্রধান উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর মানসিক চেতনার বিকাশ সাধন করা। বিদ্যালয় হল সমাজের
ক্ষুদ্র সংস্করণ। এখানে শিক্ষার্থীরা সমাজ জীবনের উপযোগী আচার-আচরণ, মনোভাব, সমস্যা-সমাধানের
উপযোগী গুণাবলি ও দক্ষতা অর্জন করে। সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাস্তব
জগতের সংস্পর্শে আসে এবং বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়।
(৬) শিক্ষার্থীর আত্মপ্রকাশে সহায়ক : সহ-পাঠক্রমিক
কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রকাশের একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র
তৈরি হয়। এই কার্যাবলিতে শিক্ষার্থী তার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলির সম্পর্কে সচেতন
হয় এবং তার যথাযথ পরিপূরণের সুযোগ পায়। এর প্রভাবেই শিক্ষার্থী আত্মনির্ভরশীল হয়ে
ওঠে। এই আত্ম নির্ভরশীলতা ও আত্মবিশ্বাসই ব্যক্তিজীবনে সফলতার মূলে কাজ করে।
(৭) শিক্ষার্থীর নেতৃত্ব শিখনে সহায়ক : বিদ্যালয়ের সহ-পাঠক্রমিক
কর্মসূচী পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ভূমিকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীর চিন্তা ও কর্মশক্তি, উদ্যোগ গ্রহণ, মৌলিক উপায় উদ্ভাবন, সমস্যা-সমাধান,
বিচার ও বিশ্লেষণ শক্তি, ধৈৰ্য্য, সহিষ্ণুতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসংযম ইতাদি কার্যবাহী
গুণ শিক্ষার্থীকে নেতৃত্ব প্রদানে সহায়ক করে গড়ে তোলে।
(৮) অবসর বিনোদন : সহপাঠক্রমিক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা
যে বিভিন্ন ধরনের সৃজনাত্মক ও বিনোদনমূলক কাজ করার প্রশিক্ষণ পায়, পরবর্তী জীবনে সেইসব
কাজ তাদের সুস্থভাবে অবসর যাপনে সহায়তা করে। আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার যুগে অবসর যাপন
শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
(৯) শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক : সহ-পাঠক্রমিক
কার্যাবলি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের উন্নতি সাধন করে। শিক্ষক হলেন
শিক্ষার্থীর বন্ধু, দার্শনিক এবং পরিচালক (Friend, Philosopher and Guide)। শিক্ষকের
শিক্ষার্থীর প্রতি এই মনোভাব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের মর্যাদার
আচরণ গড়ে ওঠে। কিন্তু সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি পরিচালনার সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী
অতি সহজভাবে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে। এর ফলে শিক্ষক যেমন সহজ, স্বাভাবিক
হয়, তেমনি সে শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক ও সামাজিক বিকাশে সাহায্য করে।
(১০) বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ : সহ-পাঠক্রমিক
কার্যাবলি শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক অনুরাগ বিকাশে সহায়তা করে। বিদ্যালয়ে এই জাতীয়
কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশেষ বিশেষ কাজের প্রতি আগ্রহী হয়। প্রাথমিক এই অনুরাগ
সঞ্চারের দরুণ শিক্ষার্থী পরবর্তীকালে ওই ধরনের কাজে বারবার অংশগ্রহণ করে।
উপসংহার: সমগ্র আলোচনা থেকে বলা যায় যে, আধুনিক যন্ত্র
সভ্যতার যুগে এবং বৈজ্ঞানিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত শিক্ষানীতিতে শিক্ষার আধুনিক ধারণার
সুষ্ঠু বিকাশ সাধনের জন্য কেবল বিদ্যালয়ের পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি শিক্ষার্থীদের
সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাই পাঠক্রমের পাশাপাশি এইসব সহ-পাঠক্রমিক
কার্যাবলির সমন্বয়ে শিক্ষাদানের গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। আধুনিককালে এই কার্যাবলির
গুরুত্ব বিভিন্ন শিক্ষাবিদ স্বীকার করে নিয়েছেন এবং এগুলিকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত
বিষয়রূপে গণ্য করেছেন।
- সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি বলতে কি বোঝ? সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির উদ্দেশ্যগুলি লেখ।
- সহ-পাঠক্রমি কার্যাবলি কী? সহ-পাঠক্রমি কার্যাবলি পরিচালনার মূলনীতিগুলি লেখ |
- শিল্পকেন্দ্রিক বুনিয়াদি পাঠক্রম কী? কেন্দ্রীয় বা মূল পাঠক্রম বলতে কী বোঝো?
- সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি বলতে কি বোঝ? বিভিন্ন ধরনের সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করো
- পাঠক্রমের সাংগঠনিক উপাদানগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও
- পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? পাঠক্রমের গতানুগতিক ধারনার সঙ্গে আধুনিক ধারণা পার্থক্য লেখ |
- পাঠক্রম বলতে কী বোঝ? আধুনিক পাঠক্রমে বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ
- পাঠক্রমের উপাদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো (Factors of Curriculum)
- পাঠক্রম রচনা নীতিগুলি আলোচনা কর |
- পাঠক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার উদ্দেশ্য কতখানি গুরুপ্তপূর্ণ তা আলোচনা করো।
- পাঠক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর চাহিদা ও সামর্থ্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
- পাঠক্রম কী? পাঠক্রম নির্ধারণে শিশুর কোন কোন চাহিদা ও ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া?
- পাঠক্রম কয় প্রকার ও কি কি? জীবন কেন্দ্রিক পাঠক্রমের সম্পর্কে আলোচনা কর |
- গতানুগতিক পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? গতানুগতিক পাঠক্রমের উপযোগিতা লেখো। গতানুগতিক পাঠক্রমে ত্রুটি গুলি আলোচনা কর।
- পাঠক্রম কি? গতানুগতিক পাঠক্রম ও আধুনিক পাঠক্রমের মধ্যে পার্থক্য লেখ।
- কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রমের উপযোগিতা গুলি লেখ। কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রমের ত্রুটিগুলি আলোচনা কর।
- অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পাঠক্রমের উপযোগিতাগুলি লেখ। অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পাঠক্রমে ত্রুটিগুলি লেখ।
- অবিচ্ছিন্ন পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? অবিচ্ছিন্ন পাঠক্রমের উপযোগিতা এবং ত্রুটি আলোচনা কর।
- সুশিক্ষকের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Competent Teacher)
- শিক্ষার্থীর উপর বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব |
- শিক্ষায় বংশগতি ও পরিবেশের গুরুত্ব (Importance of Heridity and Environment in Education)