রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়োগ মতবাদ আলোচনা করো | State |Class XI Political Science Nore PDF |


রাষ্ট্রের
উৎপত্তি – বলপ্রয়োগ মতবাদ:

 মূল বক্তব্য:  রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত কল্পনাপ্রসূত
মতবাদগুলির মধ্যে অন্যতম হল বলপ্রয়োগ মতবাদ। এই মতবাদের মূল বক্তব্য হল, রাষ্ট্র সৃষ্টি
হয়েছে শুধুমাত্র বলপ্রয়োগের ভিত্তিতে। পশুবল বা বাহুবল হল রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।
মেকিয়াভেলির মতে, মানুষ সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা হল যে তারা অকৃতজ্ঞ, অস্থির, মিথুক,
ভীরু ও ক্ষমতালোভী (“this is to be asserted in general of men that they are
ungrateful, fickle, false, cowardly, covetous.”)

    তাই অভ্যন্তরীণ
ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রকে
সর্বদা পুলিশ ও সামরিক বাহিনী প্রস্তুত রাখতে হয়। কাজেই বলপ্রয়োগ মতবাদ অনুযায়ী,
রাষ্ট্রের অস্তিত্বের স্বার্থে শক্তি বা বলপ্রয়োগ অপরিহার্য। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস
ছিলেন বলপ্রয়োগ মতবাদের প্রথম প্রবক্তা। এই মতবাদের অন্যান্য প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হলেন মেকিয়াভেলি, হার্বার্ট স্পেনসার, ডেভিড হিউম, ট্রিটকে, লীকক, ওপেহাইমার, জোকস
প্রমুখ।

রাষ্ট্রের সৃষ্টি

  মানবসভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতে
মানবসমাজ ছিল বহু ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, দল ও উপজাতিতে বিভক্ত। প্রথম অবস্থায় কোনো শক্তিশালী
ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তি বা দলের ওপর পাশবিক বলের সাহায্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে গোষ্ঠীর
সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে গোষ্ঠী থেকে সৃষ্টি হয় উপজাতির। পরে উপজাতিগুলির মধ্যে সংঘর্ষ
দেখা দেয়। কালক্রমে দলপতির শাসনে এক-একটি এলাকায় রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, এবং দলপতি
নিজে রাজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই কারণে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার মন্তব্য করেন,
প্রথম যিনি রাজা হন তিনি ছিলেন একজন সৌভাগ্যবান যোদ্ধা।

সমালোচনা:

    রাষ্ট্রের
উৎপত্তি সম্পর্কে বলপ্রয়োগ মতবাদটি বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে।

1. একপেশে ধারণা: রাষ্ট্রের উৎপত্তির একমাত্র কারণ বলপ্রয়োগ, এ কথা
কখনোই স্বীকার করা যায় না। বলপ্রয়োগ ছাড়াও রাষ্ট্রের উৎপত্তির পিছনে আরও অনেক কারণ
রয়েছে। তাই লিকক বলেছেন যে রাষ্ট্রের উৎপত্তির অন্যতম কারণকে একমাত্র কারণ বলে মনে
করে এই মতবাদ ভুল করেছে।

2. রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে জনগণের সম্মতি : সমালোচকদের মতে, শুধুমাত্র বলপ্রয়োগের দ্বারা রাষ্ট্রীয়
কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখা যায় না। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টি. এইচ. গ্রিন-এর মতে, জনগণের
সম্মতি হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, পাশবিক বল নয় (“Will, not force, is the basis of
the State”)।

3. আনুগত্যের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা: রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্যের প্রকৃত কারণ হল সরকারের
বলপ্রয়োগ বা ক্ষমতার ভয়
বলপ্রয়োগ মতবাদ এ কথা প্রচার করে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি
করেছে। জনগণ শুধুমাত্র রাষ্ট্রশক্তির ভয়ে আইন মেনে চলে, এ কথা ঠিক নয়। আইনের যথার্থ
উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা বুঝেই তারা আইন মান্য করে থাকে।

4. স্বৈরাচারের সমর্থক: অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষার ব্যাপারে
বলপ্রয়োগকে একান্ত অপরিহার্য আখ্যা দিয়ে এই মতবাদ জনগণকে ধীনতা ও নাগরিক অধিকারের
মূল্যকে উপেক্ষা করে ক্ষমতাবান স্বৈরাচারী শাসকের কাছে নত থাকার শিক্ষা দেয়। জোর যার
মুলুক তার
বা ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরাপ্রভৃতি নীতিতে বিশ্বাস করে এই মতবাদ স্বৈরাচারিতাকে
সমর্থন করে।

5. নৈতিকতার বিরোধী: বল বা শক্তি প্রয়োগের দ্বারা রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং
তাকে সংরক্ষিত রাখার প্রয়াস নৈতিক দিক থেকে সমর্থনযোগ্য নয়। এই মতবাদে গণতন্ত্র,
সাম্য, ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিবর্তে স্বৈরাচারিতা, বাহুবল প্রভৃতি অনৈতিক বিষয়কে সমর্থন
করা হয়।

6. হীন প্রবৃত্তিকে গুরুত্বদান: দয়ামায়া, স্নেহ, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা প্রভৃতি
সদগুণের পরিবর্তে লোভ, হিংসা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি হীন প্রবৃত্তিকে এই মতবাদ গুরুত্ব
দিয়েছে।

7. সভ্যতার অগ্রগতির পরিপন্থী: বলপ্রয়োগ মতবাদ সভ্যতার পশ্চাৰ্গতি সূচিত করে। বিশ্বের
মনীষীরা বহুকাল ধরেই মানবিকতাবাদ ও সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ভিত্তিতে বিশ্বশান্তির
যে আদর্শের কথা প্রচার করে চলেছেন – বলপ্রয়োগ মতবাদ তার পরিপন্থী।

8. অগণতান্ত্রিক: বলপ্রয়োগ মতবাদ অনুসারে, রাষ্ট্রনায়করা জনগণের কাছে
কোনোভাবেই দায়বদ্ধ থাকেন। এই মতবাদে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোধকে কোনো স্বীকৃতি
দেওয়া হয়নি।

9. মানবিকতার পরিপন্থী: বলপ্রয়োগ মতবাদে যেভাবে ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন (Survival
of the fit- test) নীতিকে প্রচার করা হয়েছে তা মানবিক দিক থেকে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য
নয়। জীববিজ্ঞানের সূত্র অবলম্বন করে শুধুমাত্র বাহুবলের মাপকাঠিতে যোগ্যতম ব্যক্তিদের
বাঁচার অধিকার থাকবে, এই ধারণা হিংস্র জন্তুজানোয়ারের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলেও মানুষের
ক্ষেত্রে তা কখনোই প্রযোজ্য হতে পারে না।

10. সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক: বলপ্রয়োগ মতবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদকে উৎসাহ দেয়।
এই মতবাদের সমর্থক জার্মান আদর্শবাদী নিৎসে, ট্রিটকে, বার্নহার্ডি প্রমুখের তত্ত্ব
সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার বীজ বপন করে।

উপসংহার: এই ধরনের বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও বলপ্রয়োগ মতবাদের
ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে উপেক্ষা করা যায় না। রাষ্ট্রের উৎপত্তির পিছনে শক্তি বা বলপ্রয়োগের
যে অবদান ছিল, ইতিহাসবিদরা তা অস্বীকার করেননি। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায়
রাখার স্বার্থে বলপ্রয়োগ কত জরুরি তা সন্ত্রাসবাদ কবলিত আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির
দিকে তাকালে খুব সহজেই বুঝতে পারা যায়। রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষকে
রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিল বলপ্রয়োগ মতবাদ।
সুতরাং, এই মতবাদ সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন এমন কথা মনে করার সঙ্গত কোনো কারণ নেই।


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top