সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি
যে সমস্ত কার্যাবলি
শিক্ষার্থীর মানসিক শক্তি বিকাশের সহায়ক এবং যেগুলি শিক্ষার্থীর সু-সামঞ্জস্যপূর্ণ
ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়, পাঠক্রমের সহযোগী সেইসব বিষয় বা কার্যাবলিকে বলা হয় সহ-পাঠক্রমিক
কার্যাবলি। মনোবিদ রিভলিন (H. N. Rivlin) সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন
তা হল- যে সব কার্যাবলি শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার সামগ্রিক জীবন
বিকাশের অন্যান্য দিকে সহায়তা করে তাদেরই বলা হয় সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি।
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির বৈশিষ্ট্য
শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে
সমস্ত কার্যাবলিকের শ্রেণীকক্ষের বাইরে বহি:পাঠক্রমিক কার্যাবলী হিসেবে আখ্যা দেয়া
হয়েছিল, সেগুলিকে এই বর্তমান কালের সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী হিসেবে শ্রেণীকক্ষের ভিতর
স্থান দেয়া হয়েছে। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী
শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর জীবন বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি
নিম্নরূপ-
(১)
সৃজনশীল গুণাবলির বিকাশে সহায়ক:
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্ত সম্ভাবনা গুলিকে
বিকশিত করা। শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল গুণ সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সহপাঠক্রমিক
কার্যাবলিতে অংশ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে ওই সমস্ত গুণের বিকাশ ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
(২)
আগ্রহ সৃষ্টিকারী: শিক্ষা ব্যবস্থার
কাজ সম্পূর্ণভাবে বিফল হবে যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহের অভাব দেখা দেয়। সহপাঠক্রমিক
কার্যাবলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। বহু শিক্ষার্থী
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের তাগিদে বিদ্যালয়মুখী হয়। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে
অংশ নেওয়ার পাশাপাশি পাঠক্রমিক বিভিন্ন বিষয়ে মনোযোগী হয়ে ওঠে।
(৩)
সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহায়ক : সহপাঠক্রমিক
কার্যাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি
শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহায়ক হয়। শিক্ষার্থীরা সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে অংশ
নিলে তাদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক, নৈতিক বিকাশ ঘটে। তারা বিভিন্ন ধরনের
পরিবেশে মানিয়ে নিতে শেখে।
(৪)
একঘেয়েমি নিরসনে সহায়ক : সর্বদা শ্রেণীকক্ষের
মধ্যে আবদ্ধ থকার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একঘেয়েমি দেখা যায়। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি
দৈনন্দিন বাঁধাধরা পুথিগত শিক্ষার কাজ থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেয়। তাদের মধ্যে
একঘেয়েমি দূর করে।
(৫)
শিক্ষার্থীর চাহিদা পরিপূরণে সহায়ক : বিভিন্ন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের
চাহিদা লক্ষ করা যায়। সহপাঠক্রমিক কার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা
একদিকে যেমন আনন্দ পায়, অন্যদিকে তাদের বিশেষ বিশেষ চাহিদাও পূরণ হয়।
(৬)
ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সংযোগ সাধনকারী: সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির বিভিন্ন ধরনের সামাজিক
ক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তির তথা শিক্ষার্থীর মধ্যে সামাজিক সচেতনতা
বৃদ্ধি পায়, এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।
(৭)
আনন্দদানে সহায়ক : সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি সর্বদাই শিক্ষার্থীকে আনন্দ এবং তৃপ্তি
দেয়। শিক্ষার্থীর কাছে আনন্দদায়ক নয় এমন সব কাজকে সহপাঠক্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা
হয় না।
(৮)
জাতীয়তাবোধ বিকাশে সহায়ক : বিভিন্ন রকম সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে
জাতীয় সংহতি বা জাতীয়তাবোধের বিকাশে সহায়ক হয়।
(৯)
আন্তর্জাতিকতাবোধের বিকাশে সহায়ক: কয়েকটি সহপাঠক্রমিক কাজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে
আন্তর্জাতিকতাবোধের বিকাশে সহায়ক হয়।
(১০)
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশে সহায়ক :
সহ পাঠক্রমিক কার্যাবলীর আর এক বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক
মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে দলগতভাবে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে
শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে।
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির অপরিহার্যতা বিষয়ে
যুক্তি
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি
কেন অপরিহার্য সে-বিষয়ে দর্শনগত, মনোবিজ্ঞানসম্মত এবং সমাজত্ত্বগত যুক্তিগুলি উল্লেখ
করা যেতে পারে:
(1)
দর্শনগত যুক্তি : শিশুর মধ্যে সুপ্ত প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এবং শিশুকে
নতুন জ্ঞানের জগতের সঙ্গে পরিচিত করার জন্য প্রয়োজন সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষা। সক্রিয়তাভিত্তিক
শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে থাকে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি। শিশু বা শিক্ষার্থী
নিজের ইচ্ছায় কোনো কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলে এবং তার মধ্যে দিয়ে শিক্ষণীয়
বিষয়টি বুঝতে পারলে ওই শিক্ষা গতানুগতিক, পুথিসর্বস্ব এবং মুখস্থভিত্তিক শিক্ষার তুলনায়।
পরিবর্তে সক্রিয়তাভিত্তিক পাঠগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে।
তাই প্রকৃতিবাদী, ভাববাদী, প্রয়োগবাদী দার্শনিকরা শিক্ষার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় পাঠগ্রহণের
(2)
মনোবিজ্ঞানসম্মত যুক্তি : মনোবিদদের মতে, শিশু পৃথিবীতে জন্মলাভ করার সময় কিছু
সম্ভাবনা ও শক্তি নিয়ে জন্মায়। ওই সম্ভাবনা এবং শক্তি প্রথম অবস্থায় শিশুর মধ্যে
সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শিশুর বিভিন্ন ধরনের সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির আয়োজন করা বিশেষ
প্রয়োজন। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি অনুশীলন করলে সেই সম্ভাবনাগুলি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।
তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সহ পাঠক্রমিক কার্যাবলী আয়োজন করা বিশেষ প্রয়োজন।
(3)
সমাজতত্ত্বগত যুক্তি : শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষার্থীকে সমাজসচেতন প্রকৃত মানুষ হিসেবে
গড়ে তোলা। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে উপযুক্ত সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির ব্যবস্থা করলে শিক্ষার্থীরা
দলগতভাবে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় এবং তাদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি
সম্পর্কেও সঠিক ধারণা গড়ে ওঠে। সমাজতত্ত্ববিদরা তাই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী।
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি কার্যকর করার বিষয়ে
সুপারিশ
বিদ্যালয়ে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিকে যদি সার্থকভাবে
ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পঠনপাঠনে সহায়ক বিষয় হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়, তবে সর্বাগ্রে
প্রয়োজন —
(1) বিষয়টিকে মূল পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত
করা।
(2) এর পাশাপাশি প্রয়োজন, বিভিন্ন বিষয়ে
জ্ঞানী বা অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ করা, যাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি
পরিচালনার দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারবেন।
(3) সরকারকে এর জন্য প্রয়োজনে অতিরিক্ত অর্থ
বরাদ্দ করতে হবে।
(4) শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক-অভিভাবিকা এবং
ছাত্রছাত্রী সকলের মধ্যে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে
একটি সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে আগামী দিনে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির ফলে
ছাত্রছাত্রী এবং সমাজ বিশেষভাবে উপকৃত হবে। সুস্থ মানসিকতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে।
ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়িত হওয়ার
সুযোগ পাবে।
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী সুবিধা
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর বেশ কিছু সুবিধা লক্ষ্য
করা যায়। সেগুলি হল-
- সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী
শিক্ষার্থীদের জীবন বিকাশের বিশেষভাবে সহায়তা করে। - এই ধরনের কার্যাবলী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলাবো
জাগিয়ে তোলে। - সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী
শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশে সহায়তা করে। - শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন
প্রকার সৃজনশীল গুণের বিকাশেও বিশেষভাবে সহায়ক হয়। - এই কার্যাবলী শিক্ষার্থীদের
মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশে সহায়তা করে। - শিক্ষার্থীদের নৈতিক
এবং আধ্যাত্মিক বিকাশেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। - এই প্রকার কার্যাবলি
শিক্ষার্থীদের সমাজ ও দেশের মঙ্গলার্থে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে। - সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি
একটি শিশুকে প্রকৃত মানুষে পরিণত হতে সাহায্য করে।
- অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পরিবারের ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো
- অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বলতে কী বোঝো? অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য, অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা
- শিশুর বিকাশে সামাজিক পরিবেশের ভূমিকা
- শিশুর বিকাশে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকা
- সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির শিক্ষামূলক গুরুপ্ত বা তাৎপর্য
- সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি বলতে কি বোঝ? সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির উদ্দেশ্যগুলি লেখ।
- সহ-পাঠক্রমি কার্যাবলি কী? সহ-পাঠক্রমি কার্যাবলি পরিচালনার মূলনীতিগুলি লেখ |
- শিল্পকেন্দ্রিক বুনিয়াদি পাঠক্রম কী? কেন্দ্রীয় বা মূল পাঠক্রম বলতে কী বোঝো?
- সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি বলতে কি বোঝ? বিভিন্ন ধরনের সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করো
- পাঠক্রমের সাংগঠনিক উপাদানগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও
- পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? পাঠক্রমের গতানুগতিক ধারনার সঙ্গে আধুনিক ধারণা পার্থক্য লেখ |
- পাঠক্রম বলতে কী বোঝ? আধুনিক পাঠক্রমে বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ
- পাঠক্রমের উপাদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো (Factors of Curriculum)
- পাঠক্রম রচনা নীতিগুলি আলোচনা কর |
- পাঠক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার উদ্দেশ্য কতখানি গুরুপ্তপূর্ণ তা আলোচনা করো।
- পাঠক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর চাহিদা ও সামর্থ্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
- পাঠক্রম কী? পাঠক্রম নির্ধারণে শিশুর কোন কোন চাহিদা ও ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া?
- পাঠক্রম কয় প্রকার ও কি কি? জীবন কেন্দ্রিক পাঠক্রমের সম্পর্কে আলোচনা কর |
- গতানুগতিক পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? গতানুগতিক পাঠক্রমের উপযোগিতা লেখো। গতানুগতিক পাঠক্রমে ত্রুটি গুলি আলোচনা কর।
- পাঠক্রম কি? গতানুগতিক পাঠক্রম ও আধুনিক পাঠক্রমের মধ্যে পার্থক্য লেখ।
- কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রমের উপযোগিতা গুলি লেখ। কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রমের ত্রুটিগুলি আলোচনা কর।
- অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পাঠক্রমের উপযোগিতাগুলি লেখ। অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পাঠক্রমে ত্রুটিগুলি লেখ।
- অবিচ্ছিন্ন পাঠক্রম বলতে কী বোঝো? অবিচ্ছিন্ন পাঠক্রমের উপযোগিতা এবং ত্রুটি আলোচনা কর।
- সুশিক্ষকের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Competent Teacher)
- শিক্ষার্থীর উপর বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব |
- শিক্ষায় বংশগতি ও পরিবেশের গুরুত্ব (Importance of Heridity and Environment in Education)