ভাতে হাত ডুবিয়ে সে স্বর্গ সুখ পায় ভাতের স্পর্শে
প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর “ভাত”
গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশে “সে” সর্বনাম
টি দিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্র উচ্ছব ওরফে উৎসব নাইয়া কে নির্দেশ করা হয়েছে। যে ছিল
সুন্দরবনের মাতলা তীরবর্তী বাদাবনের এক সর্বহারা মজুর, হতদরিদ্র মানুষ। একরাত্রে তুমুল
ঝড় বৃষ্টির চাবুক খেয়ে ছটফটিয়ে তার গ্রামে উঠে আসে মাতলা। জলের তোড়ে হারিয়ে যায়
উৎসবের ঘরবাড়ি, স্ত্রী-সন্তান সবকিছু। কয়েকদিন সব হারানোর দুঃখে উৎসব অকারণ অশ্রুপাত
করে। কিন্তু পেটের জ্বালায় একদিন তার সম্বিত ফেরে। গাঁ সম্পর্কে বোন বাসিনীর সঙ্গে
কলকাতায় বড় বাড়িতে কাজ করতে যায় দু’মুঠো ভাতের আশায় ।
হোম যজ্ঞের আড়াই মণ কাঠ সমান করে কাটে শূন্য উপোসী পেটটা পূর্ণ করতে। কিন্তু বুড়ো কর্তার আকস্মিক
মৃত্যু তার ভাত পাওয়ার তীব্র আকাংখার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পিসিমা সব রান্না ভাত
তরকারি ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। উৎসবের মনের মধ্যে শুরু হয় তোলপাড়। এক মুহুর্তে
সে স্থির করে নেয় মোটা চালের ভাতের বড় ডেকচি টাতুলে নেয় সে। দূরে ফেলে দেওয়ার নাম
করে দৌড় দেয়। “বাদার ভাত তার হাতে এখন পথে ঢেলে দেবে ?”-এক নিঃশ্বাসে স্টেশনে
পৌঁছে খাবল খাবল ভাত খায়। চন্নুনির মা অর্থাৎ তার স্ত্রী রান্নাবাড়া করে আদর যত্ন
করে খাইয়েও যে সুখ দিতে পারেনি, ভাতে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সে যেন সেই স্বর্গ সুখ পায়
ভাতের স্পর্শে। মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ভাত খায়। মনে করে এবার সে আসল বাদার খোঁজ নিশ্চয়ই
পাবে। আরো ভাত খায়। আরো ভাত। এভাবে নিরন্ন মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তির তীব্র আকাংখার
পরম পরিতৃপ্তি পরিতৃপ্তি উৎসবের অন্তরকে অবর্ণনীয় আনন্দধারায় সিক্ত করে দেয় ।
কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও তার অন্তরে শিলীভূত হয়ে
থাকে স্বজন হারানোর গভীর শোক। পেটে ভাত নেই বলে সে প্রেত হয়েছিল। এখন ভাতের স্পর্শে
তার মনুষ্যত্ব জেগে ওঠে। জল ছবির মত তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে চন্নুনি, চন্নুনির মা,
ছোট খোকার ছবি। মাতলা তার বুকের থেকে সবাইকে কেড়ে নিয়েছে। আজ উৎসব পেট ভরে ভাত খাচ্ছে।
কিন্তু সে তাদেরকে এমন করে পেট ভরে খেতে দিতে পারেনি কখনো। সেই অব্যক্ত বেদনা যেন তার
প্রতিটি শিরা ধমনী বেয়ে রক্ত স্রোতের মতো ঘুরতে থাকে।
খেতে খেতে তাই সে স্বগতোক্তি করে- “চন্নুনি
রে! তুইও খা, চন্নুনির মা খাও ,ছোট খোকা খা, আমার মধ্যে বসে তোরাও খা!” সবাই মিলে
খাওয়া তৃপ্তি অনুভব করে সে। গভীর দুঃখ আর আত্মিক আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
এভাবে উৎসব চরিত্রের সুগভীর দুঃখ আর আত্মিক আনন্দের সংমিশ্রণে এক অপূর্ব মনস্তাত্ত্বিক
মুহূর্ত রচিত হয়ে ওঠে সাহিত্যিকের শিল্প দক্ষতায়।