নীলধ্বজের চরিত্র
মাইকেল মধুসূদন দত্তের “নীলধ্বজের প্রতি জনা” কবিতায় নীলধ্বজ
মাহেশ্বরী পুরীর রাজা, জনার স্বামী এবং প্রবীরের পিতা। কবিতায় নীলধ্বজের প্রত্যক্ষ
উপস্থিতি নেই। জনার দৃষ্টি দর্পণেই এই চরিত্রটি প্রতিবিম্বিত।
নীলধ্বজ ক্ষত্রিয় রাজা। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা তাঁর কাজ। কিন্তু
পুত্রহন্তা অর্জুনের কাছে অনায়াসে বশ্যতা স্বীকারের মাধ্যমে তার ক্ষত্রধর্ম লাঞ্চিত
হয়েছে।
জনার বারংবার অনুযোগ সত্ত্বেও তিনি পুত্র হত্যাকারী অর্জুনের বিরুদ্ধে অস্ত্র
ধারণ করেননি। এভাবে চরিত্রটি বীরত্বহীন, স্থানু ও নিশ্চেষ্ট ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
ঊনিশ শতকের নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতার ছোঁয়া যখন জনা চরিত্রটিকে প্রতিবাদী
করে তোলে তখন জনার মতামতকে গ্রাহ্য না করে নীলধ্বজ প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্ষণশীল
নিদর্শন হয়ে উঠেছেন।
পুত্র হত্যাকারীর বশ্যতা স্বীকার এবং তাকে মিত্র রূপে সিংহাসনে বসিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ
সংবর্ধনার আয়োজন নীলধ্বজের আত্মমর্যাদাহীনতাকেই প্রকট করে তোলে। কারণ-“…….
কেমনে তুমি, হায়, মিত্রভাবে পরশ সে কর, যাহা প্রবীরের লোহে লোহিত”?
অকাট্য যুক্তি দিয়ে জনা যখন অর্জুন, পাঞ্চালি, কুন্তি সহ মহাভারতের বিখ্যাত
চরিত্র গুলির
ভ্রষ্টতার নিদর্শন
তুলে ধরেন তখন সেসব যুক্তিতে কর্ণপাত না করে নীলধ্বজ যুক্তিবোধহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
যুগে যুগে অপার অপত্যস্নেহে পিতৃত্ব মহিমান্বিত হয়েছে কিন্তু পিতা নীলধ্বজ
সেই শাশ্বত নীতির ব্যতিক্রম। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুতেও তিনি প্রভাবিত হননি। তাঁর চরিত্রে
স্নেহময় পিতৃত্ব অনুপস্থিত।
নীলধ্বজ সন্তানহারা জননীর ব্যথা ও ব্যাকুলতার সমব্যথী হননি। সান্ত্বনা বাক্য
ও
উচ্চারিত হয়নি
তাঁর জিহ্বায়। বরং এমন দুঃখের দিনে তিনি জনার প্রতি বিরূপ-
“তুমি পতি,
ভাগ্য দোষে বাম মম প্রতি”- অর্থাৎ স্বামীর যোগ্য আচরণেও তিনি ব্যর্থ।
আসলে নীলধ্বজ বীরত্ব ও গৌরব বিস্মৃত।কোন ছলনায় তা যেন হারিয়ে গেছে। এভাবে
নীলধ্বজ চরিত্রের নির্গুণতার প্রকাশ ঘটলেও কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন যে,নীলধ্বজ রাজ্য
ও প্রজাদের কল্যাণে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেননি। দীর্ঘ রাজত্ব ও প্রজাদের কল্যাণ ভাবনা
তার পুত্রশোককেও ছাপিয়ে গেছে। ধৈর্য, স্থিরতা
ও মহানুভবতায় চরিত্রটি মহাকাব্যিক ধীরোদাও গুণান্বিত।