বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে নন্দলাল, যামিনী, অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, রামকিঙ্করের ভূমিকা |

বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে চিত্র শিল্পীদের অবদান

বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে নন্দলাল বসুর অবদান লেখ


বাংলা চিত্রকলার এক অসাধারণ প্রতিভার লক্ষত্র হলেন নন্দলাল বসু। পিসতুতো ভাই অতুল মিত্রের পরামর্শে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন নন্দলাল বসুর। হ্যাভেল সাহেব তাঁর আঁকা ছবি দেখে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেন। শিক্ষার্থী অবস্থায় ও পরবর্তীকালে তাঁর আঁকা বিখ্যাত ছবি গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- “সতী”, “শোকার্ত সিদ্ধার্থ”, “জগাই মাধাই”, “ভীষ্মের প্রতিজ্ঞয়া” ইত্যাদি। জোড়াসাঁকোর অবনীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে তিন বছর শিল্পচর্চা করেন। ভগিনী নিবেদিতার লেখা বইয়ের চিত্রসজ্জা এবং  অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের অনেক বইয়ের অলংকরণে তাঁর দক্ষতার পরিচয় রাখেন। তিনি শান্তিনিকেতনে 1920 সালে স্থায়ী ভাবে যোগদেন। ফলে তিনি শান্তিনিকেতনে শিল্প ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি 1922 খ্রিস্টাব্দে কলাভবনে অধ্যক্ষ হন।

ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে তিনি প্রথম শিল্পী যিনি আউটডোর স্টাডি বা নেচার স্টাডি উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি বর্ণ অপেক্ষা আকারে জগৎ সম্পর্কে ছাত্রদের আগ্রহী করে তোলেন। ছবি বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি মহাকাব্য ও ইতিহাস নির্ভর ছিলেন। শিল্পচর্চা  রুপাবলি তা লেখা শিল্প সংক্রান্ত গ্রন্থ।

বাঙালির চিত্রকলা চর্চার ধারায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান লেখ


বাঙালি চিত্রকলা চর্চার ধারায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থান সমকালীন শিল্পিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতীয় চিত্রকলার নব উন্মেষ ঘটে ই. বি. হ্যাভেল ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী।

       ভারতীয় চিত্রকলার নবউন্মেষে তার অবদান অতুলনীয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন দারোকনাথ ঠাকুরের পৌত্র এবং গ গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠপুত্র। শিল্পচর্চা ঠাকুরবাড়ির শিক্ষার অঙ্গ ছিল। তিনি পাশ্চাত্য রীতিতে ইংরেজ পামার ও ইতালিয়ন গিলার্ডির কাছে প্রতিকৃতি অঙ্কন শিক্ষা নেয়। অঙ্কনের মাধ্যম ছিল প্যাস্টেল, জল রং ও তেল রং। কিন্তু তাতে তাঁর পরিতৃপ্তি ছিল না। ভারতীয় চিত্র অঙ্কন রীতিতে পুনরুদ্ধারের সাধনা শুরু করেন। হ্যাভেল সাহেবের কাছ থেকে উৎসাহ ও প্রেরণা পান। হ্যাভেল সাহেবের অনুরোধে অবনীন্দ্রনাথ কলকাতায় আর্ট কলেজের উপাধ্যক্ষ হন। তিনি ভারতীয় রীতিতে প্রথম আঁকেন কৃষ্ণ নীলার ছবিগুলি। তাছাড়া ভারতীয় আঙ্গিকে তাঁর আঁকা ছবি হল ‘ঋতুসংহার’, বজ্রমুকুট, বুদ্ধ ও সুজাতা প্রভূতি উল্লেখযোগ্য চিত্রাবলী।

জাপানি শিল্পী তাই টাইকনের কাছে অবনীন্দ্রনাথ জাপানি চিত্রাংকন শেখেন। ওই রীতিতে তিনি ওমর খৈয়াম চিত্রাবলী অংকন করেন। ভারতীয় শিল্পের নবজাগরণ রূপে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বহু খ্যাতনামা শিল্পী তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ভারতীয় চিত্র অঙ্কন রীতি পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে জোরদার করে। অবনীন্দ্রনাথের বিমূর্ত সৃষ্টি “কুটুম কাটাম” তাঁর পরিণত শিল্পীমনের পরিচালক। তিনি “ওরিয়েন্টাল আর্টস” সোসাইটি স্থাপন করেন। লক্ষণীয় যে তিনি চিত্র রীতিতে দেশজ, জাপানি ও মোগল তথা পারসিক চিত্র রীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ছিলেন। দেশ-বিদেশে তাঁর ছবির প্রদর্শনী ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন।

বাংলা চিত্রকলা চর্চায় যামিনী রায়ের অবদান লেখ


    বাংলা চিত্রকলায় এক অসাধারণ প্রতিভাধর নক্ষত্র হলেন যামিনী রায়। গ্রামের মাটির মূর্তি শিল্পীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তার শিল্প জীবনের সূচনা হয়। 1906 থেকে 1914 সালে পর্যন্ত তিনি গভারমেন্ট আর্ট স্কুলের শিক্ষা গ্রহণ করেন। ফাইন আর্ট বিভাগে ইউরোপীয় একাডেমিক রীতিতে চিত্রবিদ্যা শেখেন। 1918-1919 তাঁর ছবি ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ ফাইন আর্ট এর পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ভারতীয় চিত্রকলায় তাঁর ছবির বিষয়, অঙ্কন পদ্ধতি সমকালীন অন্যান্য শিল্পিদের থাকে সম্পূর্ণ আলাদা।

     গ্রাম বাংলার নিসর্গ চিত্র, আদিবাসী জীবন ও জীবিকা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম কাহিনী নির্ভর ছবি আর পটচিত্র অঙ্কনে তিনি ছিলেন অনবদ্য। আর্ট স্কুলের গিলার্ডি সাহেবের কাছে তেলরঙে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও পরবর্তীকালে যামিনী রায় জলরঙের অসামান্য সব ছবি এঁকেছেন। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তাঁর মূল লক্ষ্যটিকে তিনি নিজেই নির্দিষ্ট করেছেন, তা যেন অন্য সকলের ছবির থেকে আলাদা হয়। তা সেই ভালই হোক বা মন্দ হোক। তেলরঙের পর্বে ইউরোপিয়ান অনেক বিষয় নিয়ে ছবি এঁকেছেন। যেমন- ল্যান্ডস্কেপ, স্টিললাইফ প্রভূতি। যামিনীর ছবিতে রাম-সীতা, রাধাকৃষ্ণ, জিশু যেমন আশ্চর্য মায়াময় পটভূমিতে উজ্জল, তেমনি কামার-কুমোর-ছুতোর প্রভূতি ছবিতে এক বাস্তব অভিব্যাক্তি লক্ষনীয়।

1934 সালে তার ছবি সর্বভারতীয় প্রদর্শনীতে ভাইসরয়ের স্বর্ণপদক লাভ করেছে। 1955 সালে তিনি পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর থেকে বেশি মূল্যবান দর্শকদের ভালোবাসা- তা পেয়েছে জীবনভর।

চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান লেখ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি সর্বোত্তম সাহিত্যের সকল বিভাগে তার সফল বিচরণ। তিনি গানের রাজা। চিত্রকলাতেও তার বিশাল অবদান। রবীন্দ্রনাথ তখন জীবনের অন্তিম পর্বে, তার বয়স ৬৭। জীবনের মাত্র বারো তেরো বছর বাকি ছবি আঁকায় মগ্ন হলেন। সারাজীবনে গান লিখেছেন প্রায় আড়াই হাজার সময় লেগেছে প্রায় ৬৫ বছর। ছবি এঁকেছেন জীবনের অন্তিম পর্বে মাত্র কয়েকটা বছর। ছবির সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। এটা চিত্রশিল্পের ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটা অসাধারন ও বিস্ময়কর ঘটনা।

      তিনি ছবি ছবি আঁকা শিক্ষা বিশেষ কিছু শেখেনি। ভাবলে অবাক হতে হয় তার ছবি কি বিষয়ে দিক থেকে, কি আঙ্গিকের দিক থেকে, কি গঠনগত দিক থেকে পুরোপুরি আধুনিক। বেঙ্গল স্কুলের শিল্পীরা যা করতে পারেনি রবিন্দ্রনাথ তা করে দেখিয়েছেন। তাঁর ছবি আঁকার ব্যাপারে কারো নির্দেশ ছিল না বলে তিনি অবাধ স্বাধীনতায়, মনের আনন্দে, নিজের ভালোলাগা ও খেয়ালখুশিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন। ছবিতে তার স্বকীয়তা ও ভাবনার মৌলিকতা এত স্পষ্ট যে দেখলে বোঝা যায় তা রবীন্দ্রিক ছবি এবং রবীন্দ্রিক ছন্দে গড়া। তিনি কবি, তিনি দার্শনিক- তাঁর ছবিতে তাঁর কৃতিত্ব ও তার দার্শনিক মনের প্রকাশ স্পষ্ট। ছবিতে রং, রেখা, বুলেট ফ্রম, কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার ধারণা ছিল। বিদেশে তার ছবি প্রদর্শনী ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন।

বাংলা চিত্রকলা চর্চায় ধারায় রামকিঙ্কর বেইজের অবদান লেখ


বাংলা চিত্রকলায় এক অসামান্য প্রতিভাবান ভাস্কর্য ছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ।  শুধু ভাস্কর্য নয় তিনি চিত্রশিল্পেরও চর্চা করেছেন একই সাথে। দারিদ্র্যের মধ্যে শৈশব অতিবাহিত হলেও শিল্পের প্রতি ছিল রামকিঙ্কর এর গভীর অনুরাগ। ছেলে বেলায় দেবদেবীর ছবি আঁকতেন, পুতুল গড়তেন। এক্তু বড়ো হওয়ার পর পোস্টার লিখে ও থিয়েটারের সিন এঁকে সামান্য আয় করতেন। তাঁর শিল্প প্রতিভার পরিচয় পেয়ে প্রভাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে 1925 সালে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। সেখানে নন্দলাল বসুর সান্নিধ্য লাভ করে এবং অল্প দিলেন মধ্যে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক হ্ন।

       তাঁর ছবিগুলি প্রধানত প্রকৃতি কেন্দ্রিক। তাঁর ভাস্কর্য ও চিত্রকলা চর্চার মূল বিষয় ছিল তার চারপাশের সাধারণ গ্রামীণ মানুষের জীবন। তাঁর আঁকা বিখ্যাত ছবিগুলি হল- “উৎসবী চোখ”, “কৃষ্ণের জন্ম”, “সাঁওতালি রমণী”, “মহিলা ও কুকুর”, ইত্যাদি। ভাস্কর্য এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-“বুদ্ধদেব”, “সুজাতা”, “হাতের সাঁওতাল”, “রবীন্দ্রনাথ” প্রমুখের মূর্তি প্রভৃতি।

        ভারতের নানাস্থানে তার ছবি ও মূর্তির প্রদর্শিত হয়েছে। 1970 সালে রামকিঙ্কর “পদ্মভূষণ” উপাধি পান। 1975 সালে বিশ্বভারতী তাকে “দেশিকোত্তম” উপাধিতে ভূষিত করে। তার থেকে বেসি মূল্যবান দর্শকের ভালোবাসা- তা তিনি পেয়েছেন সারাজীবন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
Scroll to Top