রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া বেশ
কঠিন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ধারণ
করেছেন। যেমন—[1] ঐতিহ্যবাহী বা সাবেকি সংজ্ঞা, [2] আধুনিক সংজ্ঞা ও [3] মার্কসবাদী সংজ্ঞা।
1] ঐতিহ্যবাহী বা সাবেকি সংজ্ঞাঃ-
(i)
রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
ঐতিহ্যবাহী বা সাবেকি সংজ্ঞা মূলত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির গঠন
ও কার্যাবলি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি
বিষয় ঐতিহ্যবাহী সংজ্ঞায় প্রাধান্য পেয়েছে। এই কারণে ঐতিহ্যবাহী সংজ্ঞাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা বলে অভিহিত করা হয়। গেটেলের অভিমত
হল, রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনা হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ব্রুন্টলি
বলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাষ্ট্রের বিজ্ঞান। গার্নারের বক্তব্য হল, রাষ্ট্রকে নিয়েই
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি।
(ii) সরকারকেন্দ্রিক সংজ্ঞা : সিলি, ক্যাটলিন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বলতে বুঝিয়েছেন, যা সরকার। সম্পর্কিত বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়।
(iii) রাষ্ট্র ও সরকারকেন্দ্রিক সংজ্ঞা : আবার অধ্যাপক গিলক্রিস্টের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র
ও সরকার, উভয় সম্পর্কে আলােচনা করে। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পল জানে বলেছেন, সমাজবিজ্ঞানের
যে শাখা রাষ্ট্রের ভিত্তি ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে, তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে।
2] আধুনিক সংজ্ঞা : আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনা ধারাকে নাকচ করে দিয়ে ব্যক্তি
ও গোষ্ঠীর আচরণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের অভিমত হল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে শুধুমাত্র
রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত আলোচনায় সীমায়িত করে রাখলে রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ
পরিচয় পাওয়া যাবে না। তাদের মতে, রাজনৈতিক দিককে সমাজের অন্যান্য বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন
করে দেখলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অবাস্তব হয়ে পড়বে। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড ইস্টনের
বক্তব্য অনুসারে, মূল্যের কর্তৃত্বমূলক বণ্টনের আলোচনা হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রবার্ট ডাল
ও ল্যাসওয়েল রাজনৈতিক ক্ষমতাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু করতে চেয়েছেন।
3] মার্কসবাদী সংজ্ঞা: মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজের শ্রেণিসম্পর্ক
ও শ্রেণিসংগ্রাম-সম্পর্কিত বিচারবিশ্লেষণ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। মার্কসীয় তত্ত্বে রাষ্ট্রের
উৎপত্তি ও প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মার্কসীয়
দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন
করে আলোচনা করলে তা অসম্পূর্ণ বলে পরিগণিত হবে। অর্থনীতি-নিরপেক্ষ রাজনীতির আলােচনা
বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মার্কসবাদে দাবি করা হয়।
উপরের সংজ্ঞাগুলির প্রত্যেকটিরই কিছু গ্রহণযোগ্য
দিক থাকলেও যথার্থ বিশ্লেষণে কোনোটিই সম্পূর্ণ নয়। রাজনীতি এখনকার দিনে যেমন শুধুমাত্র
রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় না, তেমনি রাষ্ট্র নিরপেক্ষ রাজনীতির আলোচনা ও
স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আবার মার্কসবাদী সংজ্ঞার প্রয়ােগ অনেক ক্ষেত্রেই সহজসাধ্য হয়
না। পরিশেষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলা যেতে
পারে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা:
1] সংকীর্ণ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবসন, ল্যাসওয়েল, অ্যালান
বল প্রমুখের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট।
শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্লেষণের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে এই
সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ।
2] কৃত্রিম,
খামখেয়ালি ও আইনকেন্দ্রিক অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞাকে
কৃত্রিম, খামখেয়ালিপূর্ণ এবং অতিমাত্রায় আইনকেন্দ্রিক বলে অভিহিত করেছেন।
3] ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর আঁচরণ উপেক্ষিতঃ আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা
ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞার তীব্র সমালোচনা করে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে,
এতে ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর আচার-আচরণ বিশ্লেষণের কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক
সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। আর্থার বেন্টলির মতে, রাজনীতির উপাদানগুলির উৎস শুধুমাত্র
রাষ্ট্র নয়। রাজনীতি শুধু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত
হয় না, সমাজের সর্বক্ষেত্রেই তা পরিব্যাপ্ত।
উপসংহার
রাষ্ট্র, সরকার প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক বিষয়গুলির মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্যসূচিকে
সীমিত রাখা সম্ভব নয়। অবশ্য রাষ্ট্রহীন রাজনীতির আলােচনাও গ্রহণযােগ্য নয়। কারণ রাষ্ট্রকে
বাদ দিয়ে রাজনৈতিক জীবনের বিশ্লেষণ কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান? পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।