প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে মুদ্রার গুরুত্ব আলোচনা করো।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মুদ্রার গুরুত্ব
প্রাচীনকালের
ইতিহাস রচনার উপাদানগুলির মধ্যে সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্যজ
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে মুদ্রার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস
রচনার একটি অন্যতম উপাদান হল মুদ্রা। সেসময় সোনা, রুপা, তামা, সিসা প্রভৃতি ধাতুর
মুদ্রা নির্মিত হত এই সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ড.
রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “মুদ্রা রাজাদের নাম ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের শাসনকার্য
সম্পর্কে জানতে যথেষ্ট সাহায্য করে”। মুদ্রার গুরুত্বগুলি হল-
ঐতিহাসিক
তথ্যের সত্যতা যাচাই করার ক্ষেত্রে মুদ্রা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো মুদ্রা
সমকালীন সাহিত্য বা লিপির তথ্যকে সমর্থন করলে সেই তথ্য আরও বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে
করা হয়। যেমন- সাতবাহনদের মুদ্রার দ্বারা তাদের ইতিহাস লিপি ও পুরাণের কাহিনির সঙ্গে
যাচাই করে নেওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুদ্রাই কোনো যুগের একমাত্র ঐতিহাসিক উপাদান
হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারতে ত্রিশজন ব্যাকট্রীয় গ্রিক রাজার
পরিচয় জানার জন্য মুদ্রা ব্যতীত অন্য কোনো উপাদান নেই। শক, পল্লব ও কুষাণদের ইতিহাস
জানার জন্য মুদ্রার ওপরেই সর্বাধিক নির্ভর করতে হয়।
প্রাচীন মুদ্রাগুলি থেকে রাজার নাম, বংশ পরিচয়
প্রভৃতি জানা। মুদ্রায় উল্লিখিত সন-তারিখ থেকে রাজাদের সিংহাসনে আরোহণ, বিশেষ কোনো
স্মরণীয় ঘটনা, রাজত্বকাল ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়। তাছাড়া, প্রাচীনকালে অনেক সময়
রাজার ধর্মই যেহেতু প্রজার ধর্ম ছিল, তাই মুদ্রায় খোদিত দেবদেবীর মূর্তি বা কোনো প্রতীক
রাষ্ট্রীয় ধর্মবিশ্বাসের তথ্য প্রদান করে থাকে। মুদ্রায় ধাতুর ব্যবহার থেকে সে-যুগের
অর্থনৈতিক অবস্থার আভাস পাওয়া যায়। মুদ্রার প্রাপ্তিস্থান থেকে রাজার রাজ্যসীমার
পরিচয় পাওয়া যায়। এবং মুদ্রা থেকে সে যুগের ধাতুশিল্প ও অন্যান্য শিল্পকলার পরিচয়
পাওয়া যায়।
মুদ্রায় আঁকা ছবি থেকে সেই সময়কার শিল্পের
উৎকর্ষের মূল্যায়ন করা সম্ভব। মুদ্রায় ব্যবহৃত ভাষা, লিপি প্রভৃতি থেকে সেই যুগের
ভাষাগত নানা তথ্য পাওয়া যায়। দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বা লেখার মাধ্যম কী ছিল তা মুদ্রা
থেকেই জানা যায়। মুদ্রার বিভিন্ন বিষয় থেকে রাজার ব্যক্তিগত রুচিশীলতা ও পছন্দ সম্পর্কিত
অনেক তথ্য পাওয়া যায়। যেমন সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় বীণাবাদনরত মূর্তি থেকে সংগীতের
প্রতি তাঁর আগ্রহের আভাস পাওয়া যায়।
ইতিহাসের অনেক জৈব উপাদান প্রাকৃতিক কারণে নষ্ট
হয়ে গেছে। কিন্তু ধাতব মুদ্রাগুলি পোকা-মাকড় বা প্রাকৃতিক কারণে নষ্ট হয় না বলে
প্রাচীনকালের অনেক তথ্য অবিকৃতভাবে মুদ্রা থেকে পাওয়া সম্ভব হয়েছে। তাই কোনো যুগের
তথ্য হিসেবে মুদ্রার ঐতিহাসিক মূল্য বেশি। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের লক্ষ্মীদেবীর মূর্তি
সংবলিত মুদ্রা, সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মূর্তি সংবলিত মুদ্রা, পাল আমলের নারায়ণী
মুদ্রা, চোলদের স্বর্ণমুদ্রা ক্যাশু প্রভৃতির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। মালব, যৌধেয়,
পাঞ্জাল প্রভৃতি রাজবংশের ইতিহাসের মূল উপাদানই হল মুদ্রা। এছাড়াও,বিদেশে পাওয়া এ
দেশীয় মুদ্রা থেকে সমকালীন ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যবিস্তার, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ প্রভৃতি সম্পর্কে জানা যায়।
উপসংহার: যেখানে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদানের স্বল্পতা
রয়েছে, সেখানে মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। আবার অন্যান্য
উপাদানের সত্যতা যাচাইয়ের কাজেও মুদ্রা সহায়কের দায়িত্ব পালন করেছে। শুধু তাই নয়,
অনেক ক্ষেত্রে মুদ্রা মূল উপাদান হিসাবে কার করে। তাই প্রাচীন মুদ্রার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
অপরিসীম। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ এই গুরুত্বের কথা স্বীকার করেছেন।