কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম
কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম (Activity Curriculum) : কর্মকেন্দ্রিক
পাঠক্রমের মৌলিক উপাদান (Basic elements) হল শিশুর সক্রিয়তা (Activity of the
child)। যে পাঠক্রম শিক্ষার্থীকে হাতে করে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাভ করতে সাহায্য করে,
তাকে কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম (Activity curriculum) বলে। বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ
জন ডিউই (John Dewey)-এর মতে, শিশুর ব্যক্তিগত চাহিদা ও আগ্রহ (individual needs
and interest of child) নিঃসৃত অবিচ্ছিন্ন কতকগুলি কর্মপ্রবাহই কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম।
এছাড়াও রুশো, ফ্রয়েবেল, মন্তেসরি, গান্ধিজি প্রমুখ শিক্ষাবিদ শিশুর সার্বিক বিকাশে
কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন। কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রমের মূল কথা
হল শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুকে কর্মের মাধ্যমে পরিবেশন করা।
কর্মকেন্দ্রিক
পাঠক্রমের উপযোগীতা :
(১) দৈহিক বিকাশ : শিক্ষার্থীর দৈহিক বিকাশে সক্রিয়
ভূমিকা পালন করে কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম। কারণ এই পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তার
দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনের সুযোগ পায়।
(২) বৌদ্ধিক বিকাশ : কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম আধুনিক
মনোবিজ্ঞানসম্মত কৌশল প্রয়োগের দ্বারা শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক
বিকাশ সাধন করে।
(৩) প্রাক্ষোভিক বিকাশ : কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রমে
শিক্ষার্থীর কর্মপ্রেরণাভিত্তিক কার্যাবলি নির্বাচিত হওয়ার ফলে তারা স্বাধীনভাবে কাজের
সুযোগ পেয়ে তাদের প্রাক্ষোভিক বিকাশ ঘটায়। আবার আত্মসক্রিয়তার মাধ্যমে পাঠগ্রহণ
করে শিক্ষার্থী আনন্দ পায়।
(৪) নৈতিক বিকাশ : কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম শিক্ষার্থীকে
একজন স্বনির্ভর, দায়িত্ববান, কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে, একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর
নৈতিক বিকাশেও সাহায্য করে।
(৫) সামাজিক বিকাশ : কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম অনুশীলনের
সময় শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার সুযোগ পায়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের শ্রমের
প্রতি মর্যাদাবোধ বাড়ে, আর সহযোগিতামূলক কাজ শিক্ষার্থীর সামাজিক বিকাশ ঘটায়।
(৬) সৃজনশীলতার বিকাশ : কর্মভিত্তিক পাঠক্রম শিক্ষার্থীর
সৃজনশীলতার বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও এই ধরনের পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের
শ্রেণিকক্ষের পাঠের একঘেয়েমি কাটিয়ে শিক্ষার্থীকে পাঠে আগ্রহপূর্ণ ও আকর্ষণীয় করে
তোলে, শিক্ষার্থীকে পরবর্তীকালে জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রেও সহায়তা করে। ছাত্র-ছাত্রীদের
পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষিকারদেরও সক্রিয় করে তোলে কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম।
কর্মকেন্দ্রিক
পাঠক্রমের ত্রুটি :
(১) কাজের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব : কর্মকেন্দ্রিক
পাঠক্রমে কর্মের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার ফলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে শিক্ষার্থীর
দূরে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া কর্মের মাধ্যমে সবকিছু শেখানো সম্ভব নয়।
ফলে পাঠক্রমের অনেক প্রয়োজনীয় অংশ বাদ চলে যায়।
(২) অতীত অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা : এই ধরনের পাঠক্রম
শিক্ষাকে কেবলমাত্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা হয়। শিক্ষার
অন্যতম লক্ষ্য হল ব্যক্তিকে বা শিক্ষার্থীকে তার অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দেওয়া। এই পাঠক্রমে অতীত অভিজ্ঞতাকে কোনো রকম গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে অতীতের ঐতিহ্য,
সংস্কৃতি, ঘটনাবলী সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা কোনো আগ্রহ দেখায় না। আর শিক্ষার্থী যদি
অতীতকে না জানে তবে শিক্ষার্থীর বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাফল্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
(৩) শিক্ষকের অভাব : এই পাঠক্রম পরিচালনা করতে
প্রয়োজন হয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের। কিন্তু সবসময় এই ধরনের শিক্ষক পাওয়া যায়
না।
(৪) শিক্ষালয়ের অভাব : এই ধরনের পাঠক্রম রূপায়নের
জন্য প্রয়োজন বিশেষ শিক্ষালয়ের। ফলে পাঠক্রম রূপায়নের ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়।
(৫) সময়ের অপ্রতুলতা :কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রমের
মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে গেলে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়। নিম্নস্তরের ক্ষেত্রে উপযুক্ত
সময় পাওয়া গেলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সময়ের অভাবের জন্য পাঠক্রমের দ্বারা শিক্ষাদান
করা সম্ভব নয়।
(৬) সকল স্তরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় : এই ধরনের
পাঠক্রম শিক্ষার সকল স্তরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ শিক্ষার অপেক্ষাকৃত উন্নত
স্তরে, শিক্ষার্থীদের বিমূর্ত জ্ঞান আহরণ করতে হয়। তাই এই পাঠক্রম শিক্ষার্থীকে বস্তুধর্মী
অভিজ্ঞতা দান করে, যা উচ্চ শ্রেণিতে সম্ভব নয়, নিম্নশ্রেণির শিশুদের জন্যই রচনা করা
সম্ভব।
(৭) আর্থিক অনটন : কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম কার্যকরী
করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা কর্মশালা প্রয়োজন হয়। কর্মশালার জন্য প্রচুর
অর্থের প্রয়োজন হয়। সব সময় ওই অর্থসংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। ফলে আর্থিক অনটনের জন্য
বহু প্রতিষ্ঠান এই পাঠক্রম পরিচালনা করতে পারে না।