সামাজিক
ক্রিয়াকলাপ হিসেবে রাজনীতির প্রকৃতি
রাষ্ট্রকেন্দ্রিক রাজনীতির সূচনা: ‘রাজনীতি’ বা ‘Politics’ শব্দটি গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল
যখন প্রথম ব্যবহার করেন তখন তা একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমায়িত ছিল। সাবেকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা
‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দটিকে রাষ্ট্রের বিজ্ঞান’(Sci-ence of the state) হিসেবে বিবেচনা
করে তাকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতির গবেষণায় আবদ্ধ
করে রেখেছিলেন। সাবেকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্র, আইন, সরকার ইত্যাদির বাইরে কিছু
চিন্তা করতে পারেননি। সেসময় সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হত না। সমাজের
যে আলাদা একটা অস্তিত্ব আছে, তাও অস্বীকার করা হত। অবশ্য সে যুগে রাজনীতিকে পৃথক দৃষ্টিকোণ
থেকে দেখা হলেও সামাজিক শক্তির বিভিন্ন উপাদানকে উপেক্ষা করা হয়নি। প্লেটো তাঁর
The Republic গ্রন্থে পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা এবং নৈতিকতার সঙ্গে আদর্শ রাষ্ট্রের সম্পর্কের
কথা তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে অ্যারিস্টটল সম্পত্তি, পরিবার প্রভৃতি সমাজজীবনের নানান
বিষয়কে রাজনীতির আলোচ্য পরিধির মধ্যে এনেছিলেন। সম্পদ বণ্টনের সঙ্গে সম্প্রদায়ের
মর্যাদা জড়িয়ে থাকার বিষয়টিকেও তিনি তুলে ধরেন। পরবর্তীকালে ইউরোপের নবজাগরণের ফলে
শিল্প ও বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে, এসময় বহু নতুন সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
নবজাগরণের যুগে সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে আলাদা করে দেখা হয়। রাজনীতির আওতা থেকে
সামাজিক বিষয়গুলি বাদ চলে যায়। রাজনীতি বলতে এসময় শুধুমাত্র রাষ্ট্র, সরকার, অন্যান্য
রাজনৈতিক সংগঠন, আইনব্যবস্থা ইত্যাদিকে জড়িয়ে থাকা কাজকর্মকে বোঝানো হয়। কোনো সামাজিক
কাজকর্ম নয়, রাষ্ট্রই রাজনীতির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু একথা স্পষ্টভাবে ঘােষণা করা হয়।
যাই হোক, সামাজিক ক্রিয়াকলাপরূপে রাজনীতির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের
গবেষণায় যেসব বিষয়গুলি উঠে এসেছে সেগুলি হল—
(1) রাজনৈতিক আচরণই সামাজিক আচরণের বহিঃপ্রকাশঃ সমাজজীবনের পটভূমিতেই রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ঘটে। এই
কারণে রাজনীতির আলোচনা সমাজ-নিরপেক্ষ হতে পারে না। সমাজজীবনকে বাদ দিয়ে রাজনীতির আলোচনা
করা হলে তা অবাস্তব বলে পরিগণিত হবে।
(2) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি মূলত সামাজিক
প্রতিষ্ঠান: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের
মতে, রাজনীতি মূলত সমাজনির্ভর। রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডি থেকে মুক্তি লাভ করে
আধুনিক রাজনীতির উপাদান সামাজিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার
মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্ব নিহিত রয়েছে।
(3) রাজনীতির উৎস সমাজ: বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্থার
এফ. বেন্টলি তাঁর The Process of Government(১৯০৮) গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, রাজনীতির
উপাদানগুলির উৎস শুধুমাত্র রাষ্ট্র নয়। সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের কাজকর্ম এবং পারস্পরিক
সম্পর্ক রাজনীতির উপাদানগুলির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীমিলার-এর মতে,
রাজনীতি সমাজেরই প্রতিরূপ।
(4) সামাজিক প্রভাব ও ক্ষমতায় রাজনীতির
অস্তিত্ব : আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের
মতে, সামাজিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় যেখানে
ক্ষমতা এবং প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সেখানে রাজনীতির অস্তিত্বই ফুটে ওঠে। অধ্যাপক ল্যাসওয়েল
তাঁর Politics গ্রন্থে রাজনীতিকে প্রভাব ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পর্যালোচনারূপে আখ্যায়িত
করেছেন। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতির মুখ্য বিষয়রূপে ক্ষমতা (Power)-র
কথা তুলে ধরেন। রবার্ট ডাল-এর মতে, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হল রাজনীতির মূল।
(5) রাজনৈতিক অংশগ্রহণ : আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি প্রধান বিষয়। জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাত্রা সামাজিক,
মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উপাদানগুলির দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই কারণে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণকে
তাঁরা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
(6) রাজনীতিতে পৌরসমাজ : সাম্প্রতিককালে পৌরসমাজের (Civil Society) ভূমিকা আধুনিক
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের রাজনীতি-সংক্রান্ত আলােচনায় স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বায়ন-বিরােধী
বিশ্ব সামাজিক ম (World So-cial Forum), পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন পরিবেশবাদী মঞ্চ,
যেমন—গ্রিন পিস মুভমেন্ট (Green Peace Movement), নারীর ক্ষমতায়নের দাবিতে আন্দোলন
(Women Empowerment Movement) প্রভৃতির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
উপরিউক্ত আলােচনার শেষে এ কথা বলা যায় যে, রাজনীতি সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো
বিষয় নয়, বরং সমাজ-সংশ্লিষ্ট বিষয়। রাজনীতির প্রকৃতি সামাজিক ক্রিয়াকলাপের ওপর
নির্ভরশীল।
Download Pdf