জীবনব্যাপী
শিক্ষার চারটি স্তম্ভ
উত্তর জীবনব্যাপী শিক্ষার চারটি স্তম্ভ
: ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে জ্যাকস্ ডেলারের নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন বিশ্বব্যাপী
পরামর্শ, আলােচনা এবং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে UNESCO-র কাছে
‘Learning: The Treasure Within’ নামক একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে জীবনব্যাপী
শিক্ষার মূল ভিত্তি হিসেবে চারটি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল :-
(১) জানতে চাওয়ার জন্য শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের জন্য শিখনঃ– সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি
পাচ্ছে। এই জ্ঞান শুধুমাত্র পণ্ডিত ব্যক্তির জন্য নয়। জ্ঞানের অধিকার সকলের। জ্ঞান
মানুষকে উন্নত অভিযোজনে অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও পরিবেশের সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে
নিতে সাহায্য করে। জ্ঞানের অভাবে মানুষ পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধকে যথাযথভাবে উপভােগ করতে
পারে না। জ্ঞান মানুষকে উদারমনা করে তোলে। পরিবেশের নানা ঘটনার যুক্তিপূর্ণ কারণ খুঁজে
পেতে জ্ঞানই মানুষকে সাহায্য করে। এককথায় বলা যায়, জ্ঞান মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয়
নিয়ে আসে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য
হল কৌতূহল। ব্যক্তি সব কিছু জানতে চায়, বুঝতে চায়, এবং জ্ঞান তার সেই চাহিদা পূরণ
করে। এই জ্ঞানার্জনের শিক্ষা শিশু পায় তার শিক্ষক এবং বইপত্র থেকে। এ ছাড়া শিশু তার
জীবনের চলার পথে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তাও জ্ঞানার্জনের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
(২) কাজ করার জন্য শিক্ষা বা কর্মদক্ষতা অর্জনের শিখন : সুষ্ঠুভাবে ও দক্ষতা সহকারে
কাজ করার শিক্ষাকে বলে কর্মদক্ষতার শিক্ষা যে বিশেষ শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের
কর্মক্ষমতার বিকাশ ঘটানো হয় তাকে কর্মের জন্য শিক্ষা বলে শিক্ষার কাজ শুধু জ্ঞান অর্জনে
সাহায্য করা নয়। সেই জ্ঞান যাতে হাতেকলমে করে ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের চাহিদা মেটানো
যায় শিক্ষা সে ব্যাপারেও মানুষকে সাহায্য করে। শিক্ষাবিদ রুম বলেন শিক্ষার তিনটি দিক
আছে জ্ঞানমূলক, কর্মমূলক এবং অনুভূতিমূলক। শিক্ষা তখনই সম্পূর্ণ্ন হবে যখন জ্ঞানমূলক
শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কর্মমূলক ও অনুভূতিমূলক শিক্ষাও সম্পন্ন হবে।
প্রকৃতির কাছ থেকে মানুষ বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে
হাত-পা, ইন্দ্রিয় ইত্যাদি পেয়েছে। একে কাজে লাগিয়ে মানুষ যাতে সুন্দর ও সার্থকভাবে
জীবনযাপন করতে পারে, তার জন্য যে শিক্ষার প্রয়ােজন তা-ই হল কাজের জন্য শিক্ষা। কোঠারি
কমিশন এই শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে পাঠক্রমে আবশ্যিকভাবে SUPW (Socially Useful Productive
work) প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে।
(৩) দলবদ্ধ জীবনযাপনের শিখন: একত্রে বসবাস করার জন্য শিক্ষা
বলতে বোঝায় পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার বিকাশ ঘটিয়ে মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক
গড়ে তোলার শিক্ষা। আজকের দিনে শিক্ষার মূলমন্ত্র হবে দলবদ্ধ জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলা, জাতীয় সম্পদের
সুষম বণ্টন প্রভৃতি মানুষ একা বেঁচে থাকতে পারে না। দলগতভাবে চলা মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তি
বা চাহিদা।এই চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নিজে যেমন উপকৃত হয়, তেমনি উপকৃত হয়
সমাজ) সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য মানুষের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলিকে উৎসাহিত করতে
হবে এবং নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য, যেমন—পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ ইত্যাদিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে
হবে) এর জন্য প্রয়ােজন একত্রে বসবাস করার জন্য শিক্ষা।
(৪) মানুষ হয়ে ওঠার জন্য শিখন: মানুষ হয়ে ওঠার জন্য শিক্ষা বলতে বোঝায় সেই শিক্ষা
যার মাধ্যমে বিবেক, মনুষ্যত্ব, নৈতিকতা, পারস্পরিক সহযোগিতা প্রভৃতি গুণের বিকাশ ঘটে।
এই শিক্ষার মূল কথা হল মূল্যবোধ গড়ে তোলা। (যথাযথ মানবিক মূল্যবোধ গড়ে উঠলে মানুষ
সহজে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রকৃত মানুষ নিজের স্বার্থের কথা ভুলে দেশের এবং
দশের উপকারে নিজেকে উৎসর্গ করে। আধুনিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিটি শিক্ষার্থীকে
প্রকৃত মানুষে রূপান্তরিত করা) সারা বিশ্বে প্রকৃত মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, হিংসা,
বিদ্বেষ তত কমতে থাকবে।
প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষায় যেসব গুণ
শিক্ষার্থীর মধ্যে আনার চেষ্টা করা হয় সেগুলি হল নৈতিক বিকাশ, চরিত্রের বিকাশ, ব্যক্তিত্বের
বিকাশ, উৎপাদনশীলতা, আর্থিক সাফল্য অর্জনের ক্ষমতা গণতান্ত্রিক আদর্শেরবিকাশ, জাতীয়
বিকাশ, আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া ইত্যাদি। যে-কোনাে মানুষের মধ্যে এই দিকগুলি বিকশিত করাই
হল মানুষ হয়ে ওঠার জন্য শিক্ষার উদ্দেশ্য।