রাষ্ট্রের উৎপত্তি
সম্পর্কিত বিবর্তনবাদ বা ঐতিহাসিক মতবাদ:
রাষ্ট্রের
উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতবাদ হল বিবর্তনবাদ বা ঐতিহাসিক মতবাদ। অধ্যাপক
গার্নারের মতে, রাষ্ট্র ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি, রাষ্ট্র পশুশক্তির ফল নয়,
চুক্তির দ্বারাও রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি, আবার পরিবারের সম্প্রসারণের কারণেও
রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। বস্তুত, রাষ্ট্রের উৎপত্তির কোনো সরল সূত্র নেই। বিবর্তনবাদ
অনুসারে, মানবসমাজের নানান জটিল উপাদানের মিশ্রণে নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিকাশের ফলে
বিবর্তনের পথে আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। বার্জেসের ভাষায়, রাষ্ট্র হল
মানবসমাজের বিরতিহীন ক্রমবিকাশের ফল।
সমাজ-বিবর্তনে
ক্রিয়াশীল উপাদান: মানবসমাজের নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিকাশের
পর্যায়ে রাষ্ট্রগঠনে যেসব উপাদানের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেগুলি হল—[1]
আসগলিপ্সা, [2] রক্তের সম্পর্ক, [3] ধর্ম, [4] যুদ্ধ বা সংঘর্ষ, [5] অর্থনৈতিক চেতনা ও [6]রাজনৈতিক চেতনা।
1. আসঙ্গলিপ্সা: আসঙ্গলিঙ্গা মানুষের সহজাত প্রবণতা। এই
প্রবণতাই একক জীবনচর্যায় অসহায় আদিম মানুষকে একে অন্যের কাছে এনে যুথবদ্ধ
জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত করে। শুরু হয় মানবসভ্যতার অগ্রগতির প্রারম্ভিক পর্যায়।
গঠিত হয় মানবসভ্যতার প্রথম প্রতিষ্ঠান পরিবার। এই পরিবারেই মানুষ আনুগত্যের প্রথম
পাঠগ্রহণ করে, শুরু হয় তার নিয়ন্ত্রিত জীবনের পথে চলা। এই নিয়ন্ত্রণই কালক্রমে
সম্প্রসারিত হয় গোষ্ঠীজীবন ও সমাজজীবনে। সমাজজীবন যত উন্নত হয়েছে ততই সুদৃঢ়
হয়েছে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, আর প্রশস্ত হয়েছে রাষ্ট্রের উদ্ভবের পথ। সুতরাং,
রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিবর্তনে মানুষের এই প্রবণতার যে একটা বিশেষ ভূমিকা আছে সে
বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।
2. রক্তের
সম্পর্ক: রাষ্ট্র
গঠনের অন্যতম প্রাথমিক উপাদান হল রক্তের সম্পর্ক। রক্তের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে
পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। ক্রমে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে
পরিবারের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পরিবার ভিন্ন হলেও তাদের পূর্বপুরুষ এক এবং সেই
সূত্রে সবার মধ্যে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে—এমন একটি ধারণা গভীর আত্মীয়তাবোধের
সৃষ্টি করেছিল। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ম্যাকাইভারের অভিমত হল, আত্মীয়তার বন্ধনের ফলে
সৃষ্টি হয় সমাজের এবং পরবর্তীকালে সমাজ থেকে সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের।
3. ধর্ম: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রক্তের
সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত আত্মীয়তাবোধ খুব বেশিদিন পরিবারগুলির বন্ধনকে অটুট রাখতে
পারেনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পরিবার ক্রমশ গোষ্ঠীর অধীনে এসেছে। ক্ৰমে গোষ্ঠীর
সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকলে রক্তের সম্পর্কজনিত একাত্মতা শিথিল হয়ে পড়ে। এইসময়
সামাজিক সংহতির শক্তিশালী হাতিয়ার ধর্ম মানুষকে পুনরায় একতার বন্ধনে আবদ্ধ করে।
অনেকে মনে করেন, গোষ্ঠীজীবনের সংকটের সময় ধর্মই সমাজজীবনকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা
করে। পুরোহিতরা ধর্মীয় বিধি ও অনুশাসন তৈরি করে সামাজিক শৃঙ্খলাকে প্রতিষ্ঠা করতে
সক্ষম হয়।
4. যুদ্ধ: আদিম সমাজে মানুষ যখন যাযাবর জীবনের পরিবর্তে একটি
নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো দলপতি অধীনে বসবাস শুরু করে তখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির
মালিকানা থেকে পরিবারের জন্ম হয়। পরে এই ব্যকিগত সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে এক
উপজাতি গোষ্ঠী নিজেদের দলপতির নেতৃত্বে অন্য উপজাতিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
এই ভাবে একজন সফল দলপতি পরবর্তীকালে রাজার স্বীকৃতি অর্জন করেন। এই কারণে
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন যে, যুই রাজা জন্ম দিয়েছে।
5. অর্থনৈতিক চেতনা: আদিম অবস্থায় মানুষ বাঁচার তাগিদে দল
বেঁধে বনজঙ্গল থেকে ফলমূল সংগ্রহ ও পশুশিকার করত। এইসময় ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি বলে
কোনো কিছু ছিল না। মানুষ প্রকৃতি থেকে যা সংগ্রহ করত। সবাই মিলে সমানভাবে ভোগ করত।
পরে পশুপালনের যুগে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে। ফলে সমাজে ধনবৈষম্য দেখা দেয়।
সেই সঙ্গে চৌর্যবৃত্তি, অসাধুতা প্রভৃতিও দেখা দেয়। তখন সামাজিক শৃঙ্খলা ও
ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে মানুষ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য
উদ্যোগী হয়।
6. রাজনৈতিক চেতনা : অর্থনৈতিক চেতনার হাত ধরে মানুষের মধ্যে
রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। আদিম যুগে রক্তের সম্পর্ক এবং ধর্মের ভীতি মানুষকে
পরিবারের প্রধান ও পুরোহিতদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করতে শিখিয়েছিল। এজন্য
এই সময়কে ‘রাজনৈতিক অবচেতনার যুগ’ আখ্যা দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে উপজাতীয় জীবনে অধিক সচেতন মানুষ
ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও প্রাণরক্ষার তাগিদে নিজ দলপতির প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য
প্রদর্শন করে। এইভাবে নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিবর্তনের এক ঐতিহাসিক পর্যায়ে
রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম হয়।
সমালোচনা:
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিবর্তনমূলক
মতবাদটি নানা দিক থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, যেমন-
1. মৌলিক নয়: সমালোচকদের মতে, বিবর্তনবাদকে কোনোমতেই মৌলিক
মতবাদ বলা যায় না। রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যান্য মতবাদ, যেমন—ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ,
বলপ্রয়োগ মতবাদ, সামাজিক চুক্তি মতবাদ প্রভৃতি থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে বিবর্তনবাদ
সমৃদ্ধ হয়েছে।
2. অসম্পূর্ণ: সমালোচকদের মতে, এখানে বিবর্তনের
পর্যায়গুলিকে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাখ্যা করা হয়েছে রাষ্ট্রের উৎপত্তি
সম্পর্কে তা করা হয়নি। কখন এবং কীভাবে মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের সূচনা হয় তার
কোনো সদুত্তর এই মতবাদে পাওয়া যায় না।
3. অযৌক্তিক: বিবর্তনবাদ যেভাবে রক্তের সম্পর্ক ও
ধর্মনির্ভর অন্ধ আনুগত্যের বিবরণ দিয়ে রাষ্ট্রের উৎপত্তির কথা তুলে ধরেছে, তা
যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ, রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রধান উপাদান রাজনৈতিক আনুগত্য কখনও অন্ধ
আনুগত্যের ফলে উদ্ভূত হতে পারে না।
4. গুরুত্বপূর্ণ নয়: মার্কসবাদী সমালোচকদের মতে, ব্যক্তিগত
সম্পত্তির উদ্ভবের আগে রাষ্ট্র গঠনের কোনো প্রয়োজন মানুষ অনুভব করেছিল বলে মনে
হয় না। এই কারণে ধর্ম, রক্তের সম্পর্ক প্রভৃতি উপাদান রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাপারে
গুরুত্বপূর্ণ নয়।
উপসৎহার. এই ধরনের অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও
বিবর্তনবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্র আকস্মিকভাবে
সৃষ্টি হয়নি বা কোনো এক অলৌকিক শক্তিও রাষ্ট্র সৃষ্টি করেনি। রাষ্ট্র হল
মানবসমাজের নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিবর্তনের এক বিশেষ পর্যায়ের ফসল। বিবর্তনবাদের এই
ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানসম্মত। তাই মতবাদটি অন্যান্য মতবাদের তুলনায় অনেক
বেশি গ্রহণযোগ্য।
More Notes:- English