গুপ্তযুগকে সুবর্ণ যুগ বলার কারণ কি
প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে গুপ্তযুগ অন্যান্য
যুগ থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র রেখে একটি সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই যুগে
সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান চর্চা, ধর্ম সব ক্ষেত্রেই এক অভূতপূর্ব উন্নতি
পরিলক্ষিত হয়। গুপ্ত যুগকে তাই ভারতবর্ষের ইতিহাসে আজও “সুবর্ণ যুগ”
হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। ঐতিহাসিক বার্নেট গুপ্ত যুগকে গ্রিসের ইতিহাসে ‘পেরিক্লিসের
যুগ’ রোমের ইতিহাসে ‘অগাস্টাসের যুগ‘ এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘এলিজাবেথের যুগ’ এর
সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সাহিত্যের
ক্ষেত্রে এই যুগে অভূতপূর্ব উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃত ভাষা ছিল এই যুগের
সাহিত্যের অন্যতম মাধ্যম। স্বয়ং সমুদ্রগুপ্ত একজন সুপন্ডিত ছিলেন, এবং তার উপাধি
ছিল ‘কবিরাজ’ বা ‘শ্রেষ্ঠ কবি’। এলাহাবাদ প্রশস্তি তে তাঁর সভাকবি হরিসেনের কবি
প্রতিভার স্বাক্ষর ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী বীরসেন একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি,
কাত্যায়ন-স্মৃতি, ব্যাস-স্মৃতি, বৃহস্পতি-স্মৃতি, দেবল স্মৃতি, নারদ স্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থগুলি এই
যুগে রচিত হয়। বিশিষ্ট
শাস্ত্রকার ঈশ্বরকৃষ্ণ, বসুবন্ধ্
অসঙ্গ, গৌরপাদ, ন্যায়দর্শনের ব্যাখ্যাকার পক্ষীলম্বামিক, বৌদ্ধ দার্শনিক দিগ্নগাচার্য এবং বিশিষ্ট বৈয়াকরণ ভূর্তিহরি, পাণিনি ও পতঞ্জলি এই যুগে আবির্ভূত হয়।
বিশাখদত্ত এর রচিত ‘মুদ্রারাক্ষস’, শূদ্রকের রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’, ভারবির ‘কিরীতার্জুনীয়ম’, ভট্টির ‘ভট্টিকাব্য’, বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্র’, দন্তীর ‘দশকুমার
চরিত্র’, অমর সিং-এর ‘শব্দকোষ’ বা ‘অভিধান’ প্রভৃতি এই যুগে রচিত হয়েছিল। মহাকবি কালিদাস এই যুগের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাঁর বিখ্যাত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম’ নাটক এবং ‘মেঘদুত, ‘কুমারসম্ভবম’, ‘ঋতুসংহার’ প্রভৃতি বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বিজ্ঞান চিকিৎসাশাস্ত্র,
রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, যতিবিজ্ঞান,
গণিত প্রভূতি- বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে এই যুগে অসম্ভবনীয় উন্নতি ঘটে।
ধন্বন্তরি ও বানভট্ট এই যুগেই তাঁদের চিকিৎসা সংক্রান্ত গ্রদেগুলি রচনা করেন। অনেকে মনে করেন, বিখ্যাত শল্যবিদ সুশ্রুত এই যুগের মানুষ ছিলেন। এই যুগে প্রথম পশু চিকিৎসা সংক্রান্ত
গ্রন্থ রচিত হয়। এমনকি 1 থেকে 9 পর্যন্ত সংখ্যার সৃষ্টি এই যুগে
প্রথম হয়েছিল। ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা পঞ্চম শতাব্দীতে থেকেই দশমিকের ব্যবহার শুরু
করেন।
‘সূর্যসিদ্ধান্ত’
গ্রন্থের রচয়িতা বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে আবর্তিত হয়। তিনি আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি আবিষ্কার
করেন।এছাড়াও তিনি প্রথম
সূর্য গ্রহন ও চন্দ্র গ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। বছরকে 365 দিনে গণনা তারই সৃষ্টি।
বহার মিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’ এবং ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’
জ্যোতির্বিজ্ঞান মূলক গ্রন্থের রচয়িতা হয় এই যুগেই। এছাড়াও ব্রহ্মগুপ্ত নামক বিখ্যাত জ্যোতিবিদদের আবির্ভাব ঘটে এই যুগে। নিউটনের বহু পূর্বে
ব্রহ্মগুপ্ত ইঙ্গিত দেন যে, বস্তুসমূহ পার্থিব অভিকর্ষের টানেই মাটিতে পড়ে।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্প প্রভূতি ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগ এক সৃজনশীল অধ্যায়। এই যুগে পূর্ববর্তী স্থাপত্য রীতির চরম বিকাশ ও নতুন রীতির
সূচনা দেখা যায়। পাথর কেটে বৌদ্ধ, জৈন ও
হিন্দু গুহা মন্দির স্থাপন এই যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অজন্তা,
ইলোরা, উদয়গিরি গুহামন্দিরগুলি এর প্রকৃষ্ট
উদাহরণ। মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগ
এক নবযুগ। এই যুগেই প্রথম স্থায়ী বস্তু অর্থাৎ ইট ও পাথর দিয়ে মন্দির নির্মাণ শুরু হয় এবং পাথরের সাহায্যে মন্দির নির্মাণ-সংক্রান্ত গ্রন্থাদি রচিত
হতে শুরু করে। কেটেশ্বর মন্দির, মণিনাগের মন্দির, সাঁচির মন্দির, দেওগড়ের দশাবতার
মন্দির, তিগোয়ার মন্দির, ভূমারের শিবমন্দির, কুবীরের পার্বতী মন্দির প্রভৃতি এই যুগের মন্দির স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য
নিদর্শন।
গান্ধার শিল্পের প্রভাব খর্ব করে এই যুগের ভাস্কর্যের এক নতুন রীতি গড়ে ওঠে। সারনাথে প্রাপ্ত
বুদ্ধমূর্তি এই যুগের ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। দেহের সুষমা,
রেখায় ব্যঞ্জন, ধ্যানানন্দের
অপূর্ব প্রশস্তি এই মুহূর্তে অদ্ভুতভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। সারনাথে প্রাপ্ত
মঞ্জুশ্রী অবলোকিতেশ্বর মূর্তি, সাঁচির
বোধিসত্ত্ব ও মথুরার ব্রোঞ্চ নির্মিত বুদ্ধমূর্তি এই যুগের ভাস্কর্য শিল্পের
অন্যতম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ভারতে
কয়েকটি শ্রেষ্ঠ শিবমূর্তি এই
যুগে নির্মিত হয়। চিত্র শিল্পের
ইতিহাসে এই যুগ গুরুত্বপূর্ণ
অধ্যায়। জলরঙের অঙ্কিত
বাঘ, অজন্তা ও ইলোরা প্রভৃতি চিত্রগুলি বিশ্ববিখ্যাত। অজান্তা 29 টি গুহাচিত্র এই যুগে চিত্রিত হয়েছিল।
গুপ্ত যুগকে অনেকে ‘হিন্দু
ধর্মে পুনরুত্থানের যুগ’ বলে চিহ্নিত
করেন। তবে এই যুগে হিন্দু ধর্মের
পুনরুত্থানের যুগ না বলে “হিন্দু ধর্মের পুনঃগঠনের যুগ” বলা যেতে পারে। এই যুগের পূর্বে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে বেশ কিছু নতুন দিকের
এ সময়ে সংযুক্তিকরণ ঘটে। ড. রাধাকুমুদ
মুখোপাধ্যায় এই যুগে হিন্দু ধর্মকে “পুরনো ও নতুন ধর্মীয় আদর্শ সমন্বয়যুক্ত
বিভিন্ন ধরনের মোজাইক” বলেছেন। বৌদ্ধ দর্শনের অসঙ্গ, কুমারজী্ নাগার্জুন, বসুবন্ধু ও পরমার্থ এ যুগে আবির্ভূত
হয়।
সম্প্রতিকালে কিছু ঐতিহাসিক গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলার
বিরোধিতা করেছেন। ড. রোমিলা থাপার বলেন যে, এই
যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষের জন্য সৃষ্টি এবং তাদেরই
বিনোদন বাহন– নিম্ন শ্রেণীর
মানুষের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক ছিল না। অধ্যাপক রনবির চক্রবর্তী বলেন যে, গুপ্ত যুগের সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে
নতুনভাবে রূপান্তর ঘটলেও এই যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা যায়না। কারণ সংস্কৃতির উন্নয়ন এর পাশাপাশি ছিল অক্ষয় ও
দুর্দশার চিত্র। পরিশেষে কথা
বলা যেতে পারে যে, সাহিত্য
শিল্পের ক্ষেত্রে গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বললেও
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কখনই ঠিক নয়।