জীবনব্যাপী
শিক্ষার উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত সংক্ষেপে আলোচনা করো
» জীবনব্যাপী শিক্ষার
উদ্দেশ্য :
ব্যাপক অর্থে শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জ্যাকস্ ডেলারের নেতৃত্বে UNESCO
কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে—একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষা হল জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। দ্রুত
পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে হলে শিক্ষাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে
সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। শিক্ষার ব্যাপ্তি হবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। ডেলারের নেতৃত্বে
UNESCO-র হেড কোয়াটার্স প্যারিসে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে একবিংশ শতাব্দীর
শিক্ষার ওপর আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক
আলোচনাচক্রে
শিক্ষার চারটি উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলি হল—জানার জন্য শিক্ষা
(Learning to know), কর্মের জন্য শিক্ষা (Learning to do), একত্রে বাঁচার জন্য শিক্ষা
(Learning to live together), প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষা (Learning to be)।
(১) জানার জন্য শিক্ষা : জ্ঞান অর্জন শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলির
মধ্যে অন্যতম। সর্বদেশের সর্বকালের শিক্ষাবিদরা তাঁদের শিক্ষাদর্শন আলোচনা করতে গিয়ে
জ্ঞান অর্জনের কথা বলেছেন। প্রাচীনকালে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল আত্মােপলদ্ধি। আত্মোপলদ্ধির
জন্য প্রয়োজন হল জ্ঞান। প্লেটোর মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হল জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের
আত্মাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। রুশাে তাঁর শিক্ষাচিন্তায় দেহ এবং আত্মার সুসংহত বিকাশের
কথা বলেছেন। এই বিকাশসাধনের প্রধান উপাদান হল ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলি সম্পর্কে
সঠিক জ্ঞান, যার পূর্ণ বিকাশের ফলেই ব্যক্তি পূর্ণ মানুষে পরিণত হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদ
ফ্রয়েবেল এবং ডিউই-ও এ বিষয়ে একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিক্ষাচিন্তায়
ব্যক্তির সম্ভাবনার ওপর অগাধ আস্থার কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ব্যক্তির মধ্যেই
জ্ঞান বিদ্যমান। শিক্ষার কাজ হল সেই জ্ঞানের প্রকাশ। শিক্ষার অন্যান্য উদ্দেশ্যপূরণে
গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জ্ঞান অর্জন।
(২) কর্মের জন্য শিক্ষা : শিক্ষার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য
হাতেকলমে কাজ করে কাজে উৎকর্য আনা। শিক্ষাগ্রহণকালে শিক্ষার্থী যদি কর্ম-অভিজ্ঞতা সঞ্চয়
করে বা সামাজিক কাজে অংশ নেওয়ার সুযােগ পায়, তাহলে কাজের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি
হয়, ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ ঘটে এবং দক্ষতা অর্জনের পরিবেশ গড়ে ওঠে। পড়ানোর সময়ে
শিক্ষক যদি সক্রিয় পদ্ধতি অবলম্বন করেন, শিক্ষার্থীও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত
হয়।
শিক্ষার এই উদ্দেশ্যটি নতুন কিছু নয়। প্রাচীনকাল
থেকেই শিক্ষার মধ্য দিয়ে কর্মদক্ষতা গড়ে তোলার চেষ্টা চলে আসছে। প্রাচীনকালের গুরুকুল
শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি শিষ্যকে অনেক কাজ করতে হত, যেমন—ভিক্ষান্ন
সংগ্রহ, যজ্ঞের জন্য সমিধ সংগ্রহ, জল তােলা ইত্যাদি। বহুক্ষেত্রে শ্রেণি’ অর্থাৎ শিল্পসংঘই
কর্মশিক্ষার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করত। মধ্যযুগের ইসলামি শিক্ষাতেও বৃত্তিশিক্ষার মধ্য
দিয়ে কর্মশিক্ষার প্রচলন দেখা যায়। এই সময়ে বৃত্তিশিক্ষা ছিল মূলত শিল্পভিত্তিক।
ব্রিটিশ যুগে হাতেকলমে শিক্ষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। উডের ডেসপ্যাচে (১৮৫৬) কারিগরি
ও বৃত্তি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষার মধ্য দিয়ে কর্মকুশলতা
গড়ে তোলার ব্যবস্থা করে।
(৩) একত্রে বাঁচার জন্য শিক্ষা : জীবনব্যাপী শিক্ষার তৃতীয়
উদ্দেশ্য হল একত্রে বাঁচার জন্য শিক্ষা। এর অর্থ হল অন্যদের সঙ্গে নিয়ে বাঁচা, তাদের
বুঝতে শেখা, তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে বোঝা এবং শ্রদ্ধা করা। এর মধ্য দিয়ে
পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মানসিকতা তৈরি হয়। তাই “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা
পরের তরে”—এই দর্শনকে সামনে রেখে সকলে মিলে এগিয়ে চলাই হল একত্রে বেঁচে থাকার শিক্ষা।
শিক্ষার এই উদ্দেশ্য আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ, শ্রী অরবিন্দ, বিবেকানন্দ প্রমুখ শিক্ষাবিদদের
শিক্ষাদর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে। কোঠারি কমিশনও এই একত্রে বেঁচে থাকা বা আন্তর্জাতিক
বোঝাপড়ার জন্য শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। UNESCO-ও এ সম্পর্কে একমত।
(৪) প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা : জীবনব্যাপী শিক্ষার চতুর্থ
উদ্দেশ্য হল প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষা। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে UNESCO থেকে প্রকাশিত
‘The World of Education Today and Tomorrow পুস্তকে শিক্ষার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে মানুষ
হওয়ার শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে এর প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ
বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কালের শিক্ষাবিদদের উল্লিখিত শিক্ষার লক্ষ্যগুলিকে
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় সকলেই ‘পূর্ণ মানুষ হওয়াকে শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য
বলে ব্যক্ত করেছেন। প্রাচীনকালে মানুষ হওয়া বলতে ব্ৰত্মজ্ঞান উপলব্ধিকে বোঝাত। প্লেটো,
সক্রেটিস, কমেনিয়াস, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ভাববাদী শিক্ষা দার্শনিকদের মতে
শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল আত্মোপলদ্ধি। এই আত্মোপলদ্ধির জন্য প্রয়োজন ব্যক্তির আত্মবিকাশ।