পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক অবস্থা ঋক বৈদিক যুগের তুলনায় কী কি ভাবে পৃথক ছিল?
পরবর্তী বৈদিক যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা
রাজনৈতি অবস্থা ঋক বৈদিক যুগের তুলনায় কতটা পৃথক ছিল তা নিরূপণ করতে গেলে ঋক বৈদিক
যুগের রাজনৈতিক অবস্থা কিছুটা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত ভারতের সর্ব প্রাচীন
সাহিত্য ঋক বেদ থেকে ঋক বৈদিক যুগের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
শ্রেণীবিভাজন:-
উল্লেখ্য, ঋকবৈদিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল কৌম
বা উপজাতি ভিত্তিক। সুতরাং এ যুগের মানুষ বা ব্যক্তি বিশেষর পরিচয় নির্ধারিত হত,সে
কোন কৌম বা উপজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই মানুষের প্রাথমিক আনুগত্য ছিল উপজাতি গোষ্ঠীর
প্রতি, যেগুলিকে ‘জন‘ বলা হত। তবে এযুগের রাজনৈতিক সংগঠনের মূল ভিত্তি ছিল পিতৃতান্ত্রিক
পরিবার বা ‘কুল‘।
পরিবারের কর্তাকে বলা হত ‘গৃহপতি‘ বা ‘কুলক‘,
আবার কতকগুলি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠতো গ্রাম, শাসক কতা ছিলেন গ্রামনী ‘ব্রজপতি’। ঋকবেদের
যে জন, বিশ, গন প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল, তা সামগ্রিকভাবে জনগোষ্ঠীকে বোঝাত।
ঋকবেদের ‘রাজান‘ বা ‘রাজা‘ শব্দটি বহুবার
ব্যবহৃত হলেও সেযুগে রাজন শব্দটি দ্বারা বিশ বা জন বা গোষ্ঠীর প্রধানকে নির্দেশ করা
হয়েছে।
অন্যান্য কর্মচারি- বিদথ
যাইহোক, ঋক বৈদিক যুগের আলোচ্য রাজা বা বিশপতিকে
শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে পুরোহিত সেনানী, দূত, প্রভৃতি কর্মচারী সাহায্য করতো।
ছাড়াও এযুগের রাজকার্য পরিচালনায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল,
যাদের মধ্যে অন্যতম হল সভা ও সমিতি। তবে ঋক বৈদিক যুগের প্রারম্ভিক পূর্বে ‘বিদথ’নামক
প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সম্ভবত শেষ পর্যায়ে সভা ও সমিতি উদ্ভব ঘটে। ‘বিদথ‘ বা
‘বিধাতা‘ নামক সংগঠনটি ছিল নীতি নির্ধারক প্রতিষ্ঠান,যাতে উপজাতি বা কৌমের সদস্যদের
সাধারণ বিষয়গুলি ছাড়াও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ও আলোচনা হত। তবে বিদথের প্রকৃত
কার্যাবলী কী ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
সভা ও সমিতি:-
ঋক বেদে 122 বার বিদথের উল্লেখ আছে। কিন্তু
সভা-সমিতির উল্লেখ খুবই কম পাওয়া যায়। সাধারণ অর্থে সভা হল একটি সমাবেশ গৃহ যেখানে
সম্পন্ন ব্যক্তিরা মিলিত হতেন। তবে সভাকে সাধারণ নাগরিকদের কোনো স্থান ছিল না। সভাই
যারা অংশ গ্রহণ করতো। তাদের ‘সভাসহ‘ বলা হত। আর সভার বিশিষ্ট সদস্যদের বলা হত ‘সভেয়‘। বিদথ ও সভাতে নারীরা ও অংশ নিতে পারতেন।
তবে সভার রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠন ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
ব্লুম ফিল্ড মনে করেন যে, ‘সভা ছিল রাজনৈতিক সংগঠন’। সভা পরিচালককে ‘সভাপাল‘ বলা হত।
পক্ষান্তরে সমিতি ছিল জনতার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সমিতি ছিল জন প্রতিনিধিমূলক সংগঠন। রোমিলা থাপার মতে অনেক উপজাতি গোষ্ঠীর রাজা ছিল না, এক্ষেত্রে সভা ও সমিতি তাদের
শাসনকার্য পরিচালনা করতো। এমনকি রাজা নির্বাচনে ও সমিতির বিশেষ ভূমিকা ছিল। রামসরণ
শর্মার মতে, ‘ঋকবৈদিক যুগে শাসন ক্ষেত্রে সমিতি ছিল প্রধান স্তম্ভস্বরূপ’।
পরবর্তী বৈদিক যুগ:-
পক্ষান্তরে পরবর্তী বৈদিক রাষ্ট্রব্যবস্থা
ছিল ভূখন্ড ভিত্তিক।এযুগে রাজার অধিকৃত অঞ্চল যেমন বেড়ে ছিল, সেরকম তার শক্তি ও বৃদ্ধি পেয়েছিল। এযুগের
উপজাতির কতৃত্ব হয়ে উঠেছিল। আঞ্চলিক বা রাজ্য ভিত্তিক। ফলে ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীগুলি নিজেদের দখলকৃত অঞ্চলকে এমনকি
অন্যান্য উপজাতীয় ও দূষিত অঞ্চলকে, নিজেদের গোষ্ঠীর নামে অভিহিত করে।
পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের তথা ঐতরেয় ব্রাহ্মণ,
সংহিতা অর্থব বেদ প্রভৃতিতে রাজা, সম্রাট, বিরাট,একরাট, বিশ্বজননী রাষ্ট্রপাল ভোজ প্রভৃতি
উপাধি গ্রহণ করতেন বলে উল্লেখিত হয়েছে। তা সত্বে ও এই শব্দ গুলির দ্বারা ভূখণ্ডের একচ্ছত্র আধিপত্যকে নির্দেশ করে
না। ড. রামসরণ শর্মার মতে, এযুগে রাজতন্ত্রে অস্তিত্ব স্বরূপ ছিল না তবে রাজারা তাদের
ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য রাজাসূয়, রাজপেয়, অশ্বমেধ প্রভৃতি যঞ্জানুষটান সম্পাদন করতেন।
প্রসঙ্গত, পরবর্তী বৈদিক যুগের বিদথ এর কোনো
অস্তিত্ব ছিল না তবে সভা ও সমিতির অস্তিত্ব থাকলেও এ যুগের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রের
‘রত্নীনগন’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। শতপথ ব্রাহ্মণে রাজা বা নৃপতি সহ বারোজন
রন্তীনের উল্লেখ পাওয়া যায় তথা- মহিষী, সেনানী, ভাগ্যদুৎ, ক্ষতী,অখবাপ, গো-বিকতন,কলাগল, সূত,
গ্রামীণ, প্রমুখ। এছাড়া তখন রথকার ও শ্বাসকার্যে
সাহায্য করতো। ড. আলতেকার ও রমেশচন্দ্র মজুমদার মতে, রত্নীনরা সমকালীন সময়ে রাজার পরামর্শ
দাতা রুপে শাসনকার্যে অংশ নিত। এযুগে সচিব শব্দটির দ্বারা
অমাত্য বা মন্ত্রীকে বোঝাত। স্থাপতি নামক কর্মচারী সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দায়িত্ব ছিল
100 গ্রামে দায়িত্ব ছিল সতপতি নামক কর্মচারী সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দায়িত্ব ছিল। ১০০টি
গ্রামের দায়িত্ব ছিল ‘শতপথি‘ নামক কর্মচারি। গ্রাম্যবাদীন নামক কর্মচারি গ্রামের ছোটোখাটো
সমস্যার সমাধান করতো। সুতরাং পরর্বতী বৈদিক যুগে ভূখণ্ড ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সাথে
সাথে যেমন রাজার শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল, তেমনি শাসক ক্ষেত্রে ও ঋকবৈদিক যুগের তুলনায়
বৈচিত্র্য ও লক্ষ্য করা যায়।
- পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের উল্লেখিত ভারতের পাঁচটি ভৌগোলিক বিভাজনের পরিচয় দাও
- ইতিহাসের উপাদান হিসেবে লিপির গুরুত্ব
- History এবং ইতিহাসের পার্থক্য
- নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব বলতে কী বোঝো?
- প্রাচীন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর
- পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক অবস্থা ঋক বৈদিক যুগের তুলনায় কী কি ভাবে পৃথক ছিল।